
সমুদ্রবায়ু-শক্তির বিদ্যুৎকেন্দ্র এখন বিশ্ব জলবায়ু সংকট মোকাবিলার অন্যতম সম্ভাবনাময় সমাধান। সমুদ্রতটে স্থাপিত এই বিশাল টারবাইনগুলি নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন করে।সমুদ্রতলে বিছিয়ে দেওয়া বিদ্যুৎ-বাহী তারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ স্থলে পৌঁছে দেয়। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণা জানাচ্ছে, এই তার থেকে নির্গত তড়িৎচুম্বক ক্ষেত্র সমুদ্রজীবের আচরণে অপ্রত্যাশিত প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে স্ত্রী কাঁকড়াদের ক্ষেত্রে এই প্রতিক্রিয়া খুব তীব্র। কাঁকড়া বৃহত্তর সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রে এক ছোট চরিত্র, কিন্তু তাদের মৌসুমি অভিবাসন চক্র সামুদ্রিক খাদ্যজালের এক অপরিহার্য অংশ। প্রতি বছর লাখো কাঁকড়া উপকূল বরাবর, প্রজননের জন্য যাত্রা করে। এদের উপর নির্ভর করে মাছ, জলচর পাখি এমনকি স্থানীয় মৎস্যজীবীরাও। তাই অভিবাসনের স্বাভাবিক ধারা ভেঙে গেলে তা পুরো খাদ্যশৃঙ্খলে ঢেউ তুলতে পারে। ইউনিভার্সিটি অফ পোর্টসমাউথের গবেষক এলিজাবেথ জেমসের নেতৃত্বে এক পরীক্ষায় ব্যবহৃত হয় ১২০টি অল্পবয়সী উপকূলীয় কাঁকড়া। গবেষকরা হেলমহোল্টজ কয়েল ব্যবহার করেন। এই যন্ত্রে দুটি সমান আকারের বৃত্তাকার তারের কুন্ডলীকে সমান্তরালভাবে একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে বসানো হয়। মূল উদ্দেশ্য হলো একটি সমান ও নিয়ন্ত্রিত চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করা। এর সাহাযে তাঁরা সমুদ্রতলে পাতা তারের সমতুল্য তড়িৎচুম্বক ক্ষেত্র তৈরি করেন। অতপঃর ভিডিও ট্র্যাকিং সফটওয়্যারের মাধ্যমে প্রতিটি কাঁকড়ার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হয়। ফলাফল চমকপ্রদ। দেখা গেল, স্ত্রী কাঁকড়ারা তড়িৎচুম্বক ক্ষেত্র-সমৃদ্ধ এলাকায় দীর্ঘ সময় অবস্থান করে। তুলনামূলকভাবে কাঁকড়াগুলি তারহীন অঞ্চলের চেয়ে প্রায় ১৩১% বেশি সময় কাটায় ঐ এলাকায় । বিপরীতে পুরুষ কাঁকড়াদের মধ্যে স্পষ্ট কোনো প্রবণতা দেখা যায়নি। জেমস বলেন, “এই প্রথমবার আমরা প্রমাণ পেলাম যে সমুদ্রতলের বিদ্যুৎ তারের তড়িৎচুম্বক ক্ষেত্রে স্ত্রী ও পুরুষ কাঁকড়ার প্রতিক্রিয়ায় স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে।”কেবলমাত্র অবস্থান নয়, গতিবেগেও পরিবর্তন ধরা পড়ে। মাঝারি স্তরের ক্ষেত্রে স্ত্রী কাঁকড়ারা স্বাভাবিকের তুলনায় ৩৮% কম নড়াচড়া করে। এমনকি ২৫০ μT-এর নীচে ন্যূনতম ক্ষেত্রেও আচরণ বদলায়। বিপরীতে পুরুষ কাঁকড়ারা এলোমেলো প্রতিক্রিয়া দেখায়। কখনও বেশি সক্রিয়, কখনও কম – কোনো ধারাবাহিকতা নেই। পরীক্ষার ক্ষেত্র-মাত্রা বাস্তব সমুদ্রতলের জীবন্ত তারের কাছাকাছি স্তরের সমান রাখা হয়। অর্থাৎ, এই পরিবর্তন শুধু ল্যাবরেটরির কৃত্রিম পরিবেশে নয়, প্রাকৃতিক অবস্থাতেও ঘটতে পারে। কাঁকড়ার জীবনচক্র নির্ভর করে অভিবাসনের উপরেই। স্ত্রী কাঁকড়া যদি তারের আশেপাশে আটকে পড়ে, তবে তাদের ডিম পাড়ার স্থান পাল্টে যেতে পারে। এর ফলে ডিমের বেঁচে থাকার হার কমতে পারে। জনসংখ্যা হ্রাস পেতে পারে। আর খাদ্যশৃঙ্খল জুড়ে প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে পড়তে পারে। উপকূলীয় পাখি, মাছসহ বহু প্রাণী এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২০৫০ সালের মধ্যে অনুমান করা হচ্ছে, সমুদ্রতলের কম (০.১%) অংশে এই ধরনের তার থাকবে। সংখ্যাটি সামান্য হলেও, তাদের অবস্থানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি তার যদি অভিবাসনের মূল পথে পড়ে, তবে সেটি কার্যত এক অদৃশ্য বাধার মতো কাজ করবে। গবেষণাপত্রের সহলেখক অ্যালেক্স ফোর্ড বলেন, “এই ক্ষেত্রে স্ত্রী কাঁকড়ারা বেশি সংবেদনশীল। সম্ভবত তাদের মধ্যে কোনো বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে, তড়িৎচুম্বক সংকেত ধরার। আমরা এখন সেই রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা করছি।” তিনি আরও যোগ করেন, “মানবসৃষ্ট অবকাঠামো যখন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে, তখন আমাদের নিশ্চিত হতে হবে যে একটি সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে আমরাযেন আরেকটি সমস্যা তৈরি না করি।” নতুন এই গবেষণা সেই ধারারই এক সম্প্রসারণ। এখানে বিশেষভাবে উঠে এসেছে লিঙ্গভেদে আচরণগত পার্থক্যের গুরুত্ব। এই আবিষ্কার সামুদ্রিক জীববিদ্যার সামনে নতুন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে। শুধু কাঁকড়াই নয়, বহু প্রাণী যেমন – সি-টার্টল, স্যামন মাছ,এমনকি হাঙরও এই চৌম্বক ক্ষেত্রের উপর নির্ভর করে চলাফেরা করে। তাহলে কি স্ত্রী কচ্ছপ বা মাছও একই ধরনের সংবেদনশীলতা দেখাবে? একটি তারের কারণে কি পুরো জনসংখ্যার পথ পরিবর্তন হতে পারে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তারের অবস্থান নির্ধারণে সূক্ষ্ম পরিকল্পনা, সম্ভাব্য শিল্ডিং(ঢাল) প্রযুক্তি, আর পরিবেশগত যাত্রাপথ তৈরি করা অত্যন্ত জরুরি। কাঁকড়ার এই প্রতিক্রিয়া এক সতর্কবার্তা। নবায়নযোগ্য শক্তি আর সামুদ্রিক স্বাস্থ্যকে পাশাপাশি এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। নইলে আমরা হয়তো এক সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে আরেকটি গভীরতর সমস্যা ডেকে আনব।
সূত্র : Female Crabs Are More Sensitive to Environmentally Relevant Electromagnetic Fields from Submarine Power by
Elizabeth James, Environmental Science & Technology Letters
Cite this: Environ. Sci. Technol. Lett. Published September 15, 2025