
একটা রাজহত্যা দিয়ে শুরু করা যাক। ১৭৯৩ সালের ১৬ জানুয়ারী ন্যাশনাল কনভেনশন অব প্যারিস রাজা লুই ষোলকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করে। বিদ্রোহীদের মধ্যে সম্ভবত বিজ্ঞানের গভীরতম মূল প্রেথিত ছিলঃ বস্তুর বর্তমান অবস্থাকে গ্রহণ না করে প্রত্যাখ্যান করা। বিদ্রোহীদের মধ্যে রোবেস্পিয়েরর (Robespierre) এক বন্ধু ল্যাজারে কার্ণো (Lazare Carnot) মারাত্মক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কার্ণো, পারস্যের বিখ্যাত কবি সাডি সিরাজীর (Saadi Shirazi) কবিতার প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। বিদ্রোহীরা কবি সিরাজীকে ধরলেন এবং তাঁকে ক্রীতদাস করে রাখলেন। সেই সময় তিনি কিছু উজ্জ্বল কবিতা লিখেছিলেন, যা জাতি সংঘের মূল দরজার সামনে প্রোথিত আছে। কবিতাটা এইরকমঃ
এডামের সব ছেলেরাই
এক শরীরেরই অংশ,
একই নির্যাস দিয়ে তৈরি।
সময় যখন আমাদের পীড়িত করে
শরীরের এক অংশকে
অন্য অংশগুলোও তা অনুভব করে।
তুমি যদি অন্যের কষ্ট না অনুভব কর
তুমি মানুষ নামের যোগ্য নও।
হয়ত কবিতা বিজ্ঞানের আরেকটা গভীরতম মূলঃ দৃশ্যমানের বাইরে দেখার ক্ষমতা। কার্ণো তাঁর প্রথম ছেলের নাম রেখেছিলেন সাডি। সাডি কার্ণো কবিতা এবং বিদ্রোহের মাঝে জন্মগ্রহণ করেন।
উনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে স্টীম এঞ্জিনে, আগুনের ব্যবহারে বস্তুকে পরিবর্তন করা, এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। যুবক কার্ণোর স্টীম এঞ্জিন নিয়ে উৎসাহ ছিল। ১৮২৪ সালে তিনি ‘আগুনের ক্ষমতার বিষয়বস্তুর প্রতিফলন (Reflections on the Motive Power of Fire)’ – নামে একটা পুস্তিকা প্রকাশ করেন। এই পুস্তিকাতে এইসব যন্ত্রগুলোর তাত্ত্বিক দিক বোঝার চেষ্টা করেন। এই বইতে তিনি কিছু ভুল অনুমান করেছিলেন। যেমন, তিনি ভেবেছিলেন, তাপ একপ্রকার জমাটবদ্ধ অস্তিত্ব – একধরনের তরল যেটা গরম থেকে ঠান্ডায় পড়ে শক্তি উৎপাদন করে। এটা যেন অনেকটা জলপ্রপাতের মতো, উঁচু থেকে নীচে পড়ে এবং শক্তি উৎপন্ন করে। কিন্তু এখানে একটা প্রধান ধারনার জন্ম দিয়েছেঃ স্টীম এঞ্জিনে তাপ গরম থেকে ঠান্ডা বস্তুতে প্রবাহিত হয়।
সাডির এই পুস্তিকা একজন উগ্র-চোখের, কঠোর, প্রুসিয়ান অধ্যাপক রুডলফ ক্লসিয়াসের (Rudolf Clausius) হাতে এল। তিনিই প্রথমে এখান থেকে মৌলিক তত্ত্বটি আবিষ্কার করলেন এবং এটি তাঁকে বিখ্যাত করে দিলঃ চারপাশে যদি কিছু পরিবর্তন না হয়, তাপ কখনো ঠান্ডা বস্তু থেকে উষ্ণ বস্তুতে প্রবাহিত হয় না।
এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার যেটা হোল, পতনশীল বস্তুর সাথে তাপের একটা তফাৎ আছে। একটা বলকে যদি ফেলা হয় সেটি আবার প্রত্যাবর্তন করে, কিন্তু তাপ করে্না।
পদার্থবিদ্যার এটাই একমাত্র মৌলিক তত্ত্ব, যেটা ভবিষ্যৎ থেকে অতীতকে আলাদা করে। অন্য কোন তত্ত্ব – যেমন, নিউটনের বলবিদ্যা, ম্যাক্সওয়েলের তড়িৎ এবং চুম্বকের তত্ত্ব, আইনস্টাইনের আপেক্ষিক মহাকর্ষ তত্ত্ব, হাইজেনবার্গ, ডির্যাক বা শ্রোডিঙ্গারের তৈরি করা কোয়ান্টাম বলবিদ্যার বিভিন্ন তত্ত্ব –এগুলো কোনটাই ভবিষ্যৎ থেকে অতীতকে আলাদা করে না। এইসব সমীকরণে যদি কোন ঘটনার অগ্রগতি দেখানো হয়, তাহলে সেটা সময়ের পেছনের দিকেও দেখনো যাবে। বিশ্বের মৌলিক সমীকরণে, যেখানে তাপের ব্যাপার আছে, সেখানেই কেবলমাত্র সময়ের দিগ্নির্দেশ থাকে। সময়ের সাথে তাপের সম্পর্ক একেবারে প্রাথমিক। প্রতিটা মুহূর্তে, যখনই অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে পার্থক্য হয়, তাপ সেখানেই জড়িত থাকে। কোন ঘটনার ক্রমে, যদি তাপ উৎপন্ন হয়, সময়ের পেছনদিকে যাওয়া তখন অলীক একটা ব্যাপার।
যদি আমরা এমন একটা ফিল্ম দেখি, যেখানে একটা বল গড়িয়ে যাচ্ছে, আমি কখনোই বলতে পারব না যে ফিল্মটি ঠিকমতো দেখানো হচ্ছে নাকি উল্টোদিকে হচ্ছে। যদি বলটা থেমে যায়, তাহলে ফিল্মটা ঠিকভাবেই চলছে সেটা বলা যেতে পারে। যদি উল্টোপথে ফিল্মটি চালানো হয়, তখন এক অকল্পনীয় ঘটনা ঘটতে দেখা যায়ঃ একটা বল যেন নিজে নিজেই গড়াতে শুরু করে! ঘর্ষনের জন্য বলের গতিটি আস্তে হয় এবং আস্তে আস্তে থেমে যায়, আর ঘর্ষনের ফলে তাপ উৎপন্ন হয়। একমাত্র যেখানেই তাপ উৎপন্ন হয় সেখানেই অতীত আর ভবিষ্যৎকে আলাদা করা যায়। যেমন, চিন্তা অতীত থেকে ভবিষ্যৎ আলাদা করে, কারণ চিন্তা আমাদের মাথা গরম করে দেয়………।
এই অপরিবর্তনীয় একমুখী তাপের চলন মাপার জন্য ক্লসিয়াস একটা রাশির প্রস্তাবনা করেন। তিনি একজন জার্মান ছিলেন এবং প্রাচীন গ্রীক থেকে তিনি রাশিটার নাম দেন ‘এনট্রপি’। এই এনট্রপি, যাকে আমরা S দিয়ে নির্দেশিত করি, কোন বিচ্ছিন্ন প্রত্রিয়ায় বৃদ্ধি পায় বা এক থাকে, কিন্তু কখনোই কমে না। এনট্রপি একটা পরিমাপযোগ্য এবং গণনাযোগ্য রাশি। সমীকরণ হিসাবে লিখলে লিখতে পারি,
∆S≥0
এই সমীকরণকে তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সুত্র বলা হয়। (প্রথম সুত্রটি শক্তির সংরক্ষন সুত্রকে নির্দেশ কর্রে।) সমীকরণটির মূল কথা হচ্ছে, তাপ কেবলমাত্র গরম বস্তু থেকে ঠান্ডার দিকেই প্রবাহিত হয়, উল্টোদিকে নয়।
মৌলিক পদার্থবিদ্যার এই একটা সমীকরণই অতীত এবং ভবিষ্যতের তফাৎ করে দেয়। এটি সময়ের প্রবাহের কথা বলে। এই অসামান্য সমীকরণের পেছনে সারা বিশ্ব লুকিয়ে আছে।