‘তালিবান’-দের সম্বিত ফিরুক

‘তালিবান’-দের সম্বিত ফিরুক

অভিজিৎ চৌধুরী
Posted on ৬ অক্টোবর, ২০২১

আফগানিস্থান জ্বলছে, মানুষ কাতরাচ্ছে পথে ঘাটে। আমেরিকার হাতে রাজনৈতিক পরাধীনতার থেকে বেরনোর রাস্তা হিসাবে সায়ত্বশাসনের যে রাস্তা আত্মঘাতী প্রবল যুদ্ধের হাত ধরে সেখানে আসছে, তা সব মিলিয়ে গভীর সামাজিক পরাধীনতার এবং মধ্যযুগীয় সামন্ত শাসনের ইঙ্গিতবহ বলে বহু মানুষ মনে করছেন। দলে দলে মানুষের দেশ ছাড়ার, হতাহত হবার দৃশ্য সাড়া পৃথিবীর সচেতন বিবেক ও ভাবনাকে নাড়া দিচ্ছে। সামাজিক অস্থিরতা, রাজনৈতিক প্রলয়, জীবনের অসুরক্ষা সব মানুষকেই ভাবায়। আফগানিস্থানের বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞানকর্মীরা এই মুহূর্তে অসহায়ের মতো খাঁচায় আটকানো। বিজ্ঞানী না থাকলে বিজ্ঞান ও থাকে না। কাজেই আফগানবিজ্ঞানী ও বিজ্ঞানকর্মীদের জীবন বাঁচানোই যেখানে সমস্যা সেই পরিবেশে তারা বিজ্ঞানের কাজ কতটা করতে পারবেন তা অবশ্যই প্রশ্ন। কিন্তু তার থেকেও বড় প্রশ্ন বিজ্ঞানীরা জীবন বাঁচাবেন কি ভাবে? নতুন শাসকদের কাছে ‘বিজ্ঞান’ আদৌ সহায়ক বস্তু বলে তাদের অতিপরিচিত আদিম ভাবনায় উঠে আসবে কিনা সে প্রশ্নও থেকে যাচ্ছে।
যুগে যুগে এমনটা হয়েছে। না, অন্ধকারের মাদকতায় আচ্ছন্ন স্বৈরশাসকদের সামন্ত চিন্তায় বিজ্ঞানের কোন জায়গা থাকে না। আইনস্টাইনকেও জার্মানি ছাড়তে হয়েছিল- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগেই- ১৯৩৩ সালে। ১৯২২ সালে নোবেল পুরষ্কারে সম্মানিত বিজ্ঞানী হিটলারের একনায়কতন্ত্রী মনোভাব ও মানববিদ্বেষী দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রকাশ্যে বিরোধিতা করার শাস্তি হিসাবে শুনেছিলেন যে তার বিজ্ঞান হচ্ছে ‘ইহুদি বিজ্ঞান’। আইনস্টাইনের ছবি টাঙ্গিয়ে ল্যাম্পপোস্টে নাৎসীরা লিখেছিল ‘এখনও হত্যা করা হয়নি যাকে’। নেহাত জীবন রক্ষার জন্য, বিজ্ঞানের সুর সাধনা চালিয়ে যাবার জন্য আইনস্টাইন ’৩৩ সালে প্রায় নিঃশব্দে জার্মানি ছাড়েন। বেলজিয়াম, ইংল্যান্ড হয়ে পৌঁছান আমেরিকায়। যুদ্ধ, অস্থিরতা তার মতো সৃষ্টিশীল বিজ্ঞানীর কাজের কতটা ক্ষতি করেছিল হিসেবের স্পর্ধা আমাদের নেই। কিন্তু তার আত্মিক যন্ত্রণা- শরণার্থীর বেদনা আমাদের নতুন করে মনে করাচ্ছে আফগান সঙ্কটের চলমান ছবিগুলো।
তালিবানরা নতুন নয়। অসহিষ্ণু, একদেশদর্শী গোষ্ঠীচিন্তায় বুঁদ হয়ে থাকা শাসকেরা পৃথিবীতে যখনই যে দেশেই শাসন করেন- তারাই একম্ম করে থাকেন। যুক্তি, তথ্য আর তর্ক করার বিজ্ঞানের মূলউপাদানগুলো এদের কাছে অসহনীয় ঠেকে। আঁধার নামিয়ে এনে সামাজিক নিষ্পেষণ, ভীতি আর সর্বব্যাপী আত্মসমর্পণের বাতাবরণ স্বৈরশাসকেরা তৈরি করেন। বিজ্ঞানের আলো তাদের কাছে বিভীষিকার মতো ঠেকে। তাই চিন্তাশীল আর বিজ্ঞানীদের উপর রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাবও এসে পড়ে খুব তাড়াতাড়ি। বিজ্ঞানের কোন বিশ্বাসের ভিত্তি নেই। বিশ্বাসের আগল ভেঙ্গে নতুন চিন্তায় ডুব দেওয়া, অজানা তথ্যকে তুলে আনাই বিজ্ঞানের কাজ। আফগান তালিবানদের হাত থেকে মুক্তি পেতে বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞানের কাজে যুক্ত মানুষদের হুড়োহুড়ি এই যুগভাবনাকেই আবার সামনে এনেছে। ঘাড়ের কাছে বন্দুকের নল থাকলে বিজ্ঞানের নিরীক্ষা আদৌ এগোয় না। স্বচ্ছ আকাশ, মুক্ত চিন্তা, প্রশ্ন করার অধিকারকে প্রশ্রয় দিয়েই যে কোন দেশের শাসকদের বিজ্ঞানকে এগোনোর পথ করে দিতে হয়। নচেৎ দেশও এগোয় না। বিজ্ঞানীরা তোতা পাখী হন না। আর আলমারীতে সাজানো বিজ্ঞানের শবদেহ নিয়ে দেশও ডোবে কালের গর্ভে। আশা করব পৃথিবীজোড়া তালিবানদের সম্বিত ফিরবে। যদিও তা কষ্ট কল্পনা।