তুমি ভালো আছ, অরণ্য !

তুমি ভালো আছ, অরণ্য !

মৌমিতা পাল
Posted on ৩০ নভেম্বর, ২০২৪

বেঙ্গল টাইগার, মেছো বাঘ, ছোট মদনটাক, গ্রেট নট পাখি, মাস্ক ফিনফুট পাখি, রাজগোখরা, জলপাই রঙের কাছিম, দুই প্রজাতির ডলফিন (ইরাবতী ও গাঙ্গেয়), দুই প্রজাতির উদ্বিড়াল ও লোনাপানির কুমির- বিপন্ন প্রাণীদের লিস্ট এখানেই শেষ নয়। আরও অনেক বড়।

দায় আমার, দায় আপনার , দায় আমাদের সকলের।

নদীর পার ধরে এক ঘন সবুজ অরণ্য। বঙ্গোপসাগরের উপকূলে ব-দ্বীপ অঞ্চলে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ জঙ্গল। জোয়ার ভাটার নিত্য খেলায় সে বনের মাটি ডুবছে আবার উঠছে। না না খেলা নয়, লড়াই! আর সে লড়াই এর সম্বল তার শিকড়। শিকড়ের এক বিস্ময়কর প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে সুন্দরী, গড়াণ, গেঁওয়া, গর্জন, কেওড়া, হরগজা, খলসী, গোলপাতা আরো কত লবনাম্বু… নাম না জানা গাছগাছালি ! দুর্বার জলোচ্ছ্বাসকে প্রতিহত করে ভূমিকে আকড়ে ধরে রেখেছে অসংখ্য ঠেসমূল আর সর্পমূলের ঘন বুনট। ভাটির টানে জল সরে গেলে জেগে ওঠা চরের পলিতে কচি লেবু পাতার মতো নরম সবুজ ধানী ঘাস মাথা দোলায়।

তবে এ তো শুধু লবনাম্বুদের গল্প নয়- এ গল্প হরেক সহ-চিত্রকরদের। গাছগাছালির ঘন বুনটের মতনই, প্রাণীরা এখানে ‘বন’ কে আরও ‘সুন্দর’ করে তোলে।
অরণ্যের আড়াল থেকে বেড়িয়ে আসে চিত্রা হরিণ। হাওয়াতে ভাসতে থাকে পাখিদের ডাক। কাদা মাটির বুক খুড়তে থাকে কাদখোঁচা। এদিকে পাখনা তুলে ঝগড়াতে মত্ত মাডস্কিপারের দল। বুড়ো বক এক পা তুলে ইতিউতি চোখ ফেলে! অতর্কিতে নীল আকাশ ফুড়ে নেমে আসে শঙ্খচিল, পলকে মাছ নিয়ে উড়ে যায় চোখের সীমানা ছাড়িয়ে। তখনো গাছের ডালে বসা সাদা বুক-নীল মাছরাঙা জলে ডাইভ দেওয়ার অপেক্ষায়। এদিকে কাদার সাথে মিশে পাথরের মতো নিশ্চল কুমির হঠাৎ মাথা নাড়িয়ে জানান দেয় – সে আছে! আর অন্য পারে মন্থর বেগে গোসাপ’খানি লেজ দুলিয়ে বনের অন্দরে যাবার হাতছানি দিয়ে যায়। আবার অরণ্যের কোল থেকে লাফ দিয়ে বাইরে আসে আরো এক দুরন্ত হরিণ। হয়তো চমকে দিতে চায় তার সঙ্গীকে। খুনসুটিতে মেতে ওঠে তারা। ধীরে ধীরে কলের নাও এগোয়, সামনে খাঁড়ি। পাশে মাটি চিরে শিঙার মতো উদ্ধত সব শ্বাসমূল।

বাজ পাখির মতো নজর ফেলি ঐ আলো-আঁধারে হেঁতালের ঝোপের ফাঁক দিয়ে রাজা যদি একবার দেখা দেয়! দুর্বার গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে ধানী জমির ওপর তাহলে তো শহুরে পর্যটকের ষোলকলা পূর্ণ হয়। রাজা কখন ঝাঁপ দেবে তা তার মর্জি, সে তো আমাদের আর্জি নয় ! অরন্যের নিয়ম বড় কড়া।

লম্বা এক সাঁকো, নীচে বন্দী শিবির। বন্দী কাঁকড়া,শামুক,গাছ,হরিণ…! যদি এভাবেই বন্দি হতো মানুষ আর ভীর জমাত বাঘ, কুমির, সাপ, হরিণ, বাঁদরের দল! দামি ক্যামেরার চেয়েও যে জোরালো দৃষ্টি, তাতে তীব্র ক্ষোভ না করুণা ঠাহর করে উঠতে পারিনা। মনে ভাবি, হারিয়ে যাচ্ছে ওরা। তাই তো ওদের এভাবে আটকে রাখা ! আচ্ছা, আমারই তো চিপসের প্যাকেট, লজেন্সের মোড়ক, কোল্ড ড্রিংকের বোতল নিয়ে ওদের বাসায় ভিড় করছি, মানবিক অধিকারের দোহাই দিয়ে কুঁড়ে জমাচ্ছি ওদের অন্দরমহলে? কিংবা বিশ্বের ঐতিহ্যশালী তকমা পাওয়া অভয়ারণ্য লাগোয়া রিসর্টে গভীর রাতে তীব্র আলো জ্বালিয়ে কিংবা উচ্চস্বরে মাইক বাজিয়ে নাচ-গানে মত্ত হয়ে শহুরে উল্লাস দেখাচ্ছি এই অবলা নির্ভেজাল অরণ্যে? আর ফিরে গিয়ে, গর্বে বুক ফোলাচ্ছি, অরণ্য প্রেমিকের ভাগ্যের ভালবাসা মেখে? বাসভূমি জবরদখল করে নিচ্ছি আমারই। প্রজাতিকে ক্রমশ বিপন্ন করে তুলছি! কত স্তন্যপায়ী, উভচর, পাখি, মাছ, ডলফিন, সরীসৃপ, কীট-পতঙ্গ,গাছ।

তবে সব শুনেও তো কান বন্ধ করে আছি আমরা!

দুর্দান্ত কড়া সুরক্ষায়। ছাতার তলায় আশ্রয় পেয়েছে কত ভিন্ন প্রজাতি। ‘আম্ব্রেলা স্পিসিস’। তাতেও রয়েছে রাজা – রয়েল বেঙ্গল টাইগার। আসলে আমাদের পরস্পরের পরস্পরকে প্রয়োজন। পৃথিবীর ফুসফুস এই সুন্দরবনকে রক্ষা করতেই হবে আমাদের। নিজেদের জন্য। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। দায় আমার, দায় আপনার , দায় আমাদের সকলের।

প্রবল এক ঢেউয়ে কলের নৌকা দুলে উঠল। তরঙ্গে তরঙ্গে ধ্বনিত হতে থাকল, ‘কথা নয় কথা নয় কাজে করে দেখাও।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

20 − 11 =