জাঙ্গাঁও ও সিদ্দিপেট জেলার সীমানা বরাবর প্রায় ২৫ কিলোমিটার ছড়িয়ে রয়েছে এক বিরল ভূতাত্ত্বিক বিস্ময়। যাকে বলা যায়, “ঘণ্টা পাথর”। এসব পাথরে হাতুড়ি বা অন্য কোনো কঠিন বস্তু দিয়ে আঘাত করলে ঘণ্টার মতো পরিষ্কার ধ্বনি শোনা যায়। স্থানীয় মানুষ ও ভ্রমণকারীরা বহুদিন ধরেই এই সুরেলা বিস্ময়ে মুগ্ধ। জাঙ্গাঁও জেলার ভীরান্নাপেট ও চুঞ্চানাকোট্টা, এবং সিদ্দিপেটের বোনাকোল্লুর, বান্ডনাগারাম ও কাটকুর, এই গ্রামগুলি জুড়ে দেখা মেলে, এই ধ্বনিময় পাথরশ্রেণীর। ইতিহাসবিদদের মতে, প্রায় ২০ কোটি বছর আগে আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত থেকে যে লাভা বের হয়েছিল, তা শীতল হয়ে এ ধরনের বিশেষ পাথর তৈরি হয়েছে। পাথরগুলোতে আঘাত পড়লে, পাথরের ভিতরে থাকা উচ্চমাত্রার ফেরিক অক্সাইড ঘনত্ব বাড়ায়। আর সেই কারণেই ঘণ্টাধ্বনির মতো সুর তৈরি হয়। ভূতত্ত্ববিদদের মতে, এই পাথরগুলি আসলে প্রাকৃতিক লিথোফোন। এইসব পাথরকে আঘাত করলে নিজস্ব স্বরে ধ্বনি উৎপন্ন করে। বিজ্ঞানীরা যাকে ‘ইডিওফোনিক সাউন্ড’ বা ‘নিজস্ব ধ্বনি’ বলে বর্ণনা করেন। এই ধ্বনিময় পাথরকে ঘিরে জাগে আন্তর্জাতিক তুলনাও। ইংল্যান্ডের বিখ্যাত ‘মিউজিক্যাল স্টোনস অব স্কিড্ডো’ কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ার ‘রিংগিং রকস পার্ক’ এসকল স্থানের মতনই তেলেঙ্গানার এই পাথরগুলিও এক অনন্য ভূ-সঙ্গীতের উদাহরণ । উল্লেখযোগ্যভাবে, পেনসিলভানিয়ার উক্ত স্থানটি সরকারি সুরক্ষায় থাকা একটি পাবলিক পার্ক। ১০ থেকে ২০ ফুট উঁচু এসব পাথরের উপর পাওয়া গেছে বহু যুগের মানব ইতিহাসের স্পর্শও। পাথর যুগের কুঠার, নিওলিথিক যুগের সরঞ্জাম ধার করার দাগ, সাতবাহন যুগের সরঞ্জাম, কাকাতীয় যুগের বীরগাল্লু (বীর-মূর্তি), প্রাচীন শিলালিপি, এমনকি ভীরান্নাপেটে তেলেঙ্গানার সবচেয়ে বড় শিলাচিত্র, সবই প্রমাণ করে যে এ এলাকা বহু সভ্যতার ছোঁয়া পেয়েছে। এখানের পরিবেশ জুড়ে ছড়িয়ে আছে মানুষের তৈরি কেঁয়ার্নস বা স্থানীয় ভাষায় ‘রাক্ষসি গুল্লু’, যা আসলে প্রাচীনকালের সমাধি-চিহ্ন। বোনাকোল্লুরের নারায়ণস্বামী মন্দিরের পাথরেও দেখা যায় গরুড়, শঙ্খ-চক্র সহ নানা প্রতীকী খোদাই। স্থানীয় ইতিহাসবিদ ড. ডি.এন. স্বামী মন্তব্য করেন, “এগুলি কেবল শিলাখণ্ড নয়, এগুলি প্রকৃতির অর্কেস্ট্রা, যা প্রাগৈতিহাসিক যুগের সুর আজও বাজিয়ে চলেছে।” স্থানীয় বাসিন্দা লক্ষ্মী জানান, “পাথরকে গাইতে দেখা সত্যিই এক ধরনের জাদু। আমরা শুনেছি বহুবার, কিন্তু এর বৈজ্ঞানিক রহস্য কেউ ঠিকমতো জানতাম না।” ড. স্বামীর মতে, এই পাথরগুলির সঙ্গে অজানা সাংস্কৃতিক বা আচারসংক্রান্ত ইতিহাসও জড়িয়ে থাকতে পারে। তিনি বলেন, “এ ধরনের স্থান, প্রাচীন মানুষের আচার-অনুষ্ঠানকে প্রভাবিত করত। তবে এখনও অনেক অজানা গল্প লুকিয়ে আছে।” স্থানীয় পরিবেশকর্মী সর্বেশ্বর রেড্ডি দ্রুত সরকারি হস্তক্ষেপের দাবি জানিয়ে বলেন, “এই ২৫ কিলোমিটার এলাকাটিকে ‘ঐতিহ্যবাহী উদ্যান’ ঘোষণা করা গেলে এটি সংরক্ষিত হবে। তাছাড়া পরিবেশবান্ধব পর্যটনের বড় সুযোগও তৈরি হবে এর হাত ধরে।” ইতিমধ্যেই স্থানীয় গ্রামবাসী ও বিশেষজ্ঞরা তেলেঙ্গানা সরকারকে একটি যৌথ আবেদন পাঠিয়েছেন। তাঁদের দাবি, এই বিরল ধ্বনিময় পাথরশ্রেণীকে সরকারি সুরক্ষা দেওয়া হোক। সঠিকভাবে সংরক্ষণ ও প্রচার পেলে, এই ‘সাংগীতিক পাথর’ , তেলেঙ্গানাকে বিশ্বমানচিত্রে নতুন পরিচিতি দিতে পারে।
সূত্র : Ringing Rocks Reveal Telangana’s Pre-History Telangana; Neeraj Kumar; 3rd December, 2025.
