থ্যালামাসের ঘড়ির কাঁটা

থ্যালামাসের ঘড়ির কাঁটা

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৪ আগষ্ট, ২০২৫

মানুষের মস্তিষ্ক জন্ম থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত ধাপে ধাপে গড়ে ওঠে। প্রথমে বিকশিত হয় বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় মৌলিক ক্ষমতা। যেমন চলাফেরা, দেখা-শোনা ইত্যাদি। এরপর আসে জটিল দক্ষতা, যেমন সিদ্ধান্ত নেওয়া বা সামাজিক-মানসিক প্রক্রিয়াকরণ। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ার ড. থিওডোর স্যাটারথওয়েটের নেতৃত্বে একদল গবেষক সম্প্রতি খতিয়ে দেখেছেন, মস্তিষ্কের গভীরে থাকা থ্যালামাস শুধু ইন্দ্রিয় সংক্রান্ত ও চলন সংক্রান্ত সিগন্যালের ‘রিলে স্টেশন’ নয়। বরং মস্তিষ্কের বিকাশের সময়সূচি ও ক্রম ঠিক করার কাজেও সে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারে। ইন্দ্রিয় সংকেত বা ‘সেন্সরি সিগন্যাল’ হল সংবেদী অঙ্গ থেকে মস্তিষ্কে আসা সংকেত। এ আমাদের পঞ্চইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে পরিবেশ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে। অন্যদিকে, চলন সংকেত বা ‘মোটর সিগন্যাল’ হল মস্তিষ্ক থেকে পেশী বা গ্রন্থিতে পাঠানো সংকেত, যা আমাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ চালনায় সহায়তা করে। রিলে স্টেশনের কথা উঠছে কেন? কারণ, সমস্ত তথ্য প্রথমে থ্যালামাসের মধ্য দিয়ে যায় এবং আরও প্রক্রিয়াকরণ ও ব্যাখ্যার জন্য মস্তিষ্কের সেরিব্রাল কর্টেক্সে কোথায় যেতে হবে তার নির্দেশ পায় । গবেষণা প্রধান ড. ভ্যালেরি জে. সিডনার জানান, তারা আগেই দেখেছিলেন যে মস্তিষ্কের বাইরের স্তর (কর্টেক্স)-এর বিভিন্ন অঞ্চলের স্নায়ু-নমনীয়তা ( নিউরোপ্লাস্টিসিটি) বা শেখার ক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে। কিন্তু এখন তারা বলছেন, এই কমার ধরণ এক নয়। সেন্সরি ও মোটর অঞ্চলে (যেমন দৃষ্টি, শ্রবণ, নড়াচড়া নিয়ন্ত্রণ) শেখার ক্ষমতা শৈশবেই দ্রুত কমে যায়। কিন্তু জটিল চিন্তাভাবনা, সামাজিক যোগাযোগ ও আবেগ প্রক্রিয়াকরণের সঙ্গে জড়িত অঞ্চলে তা কৈশোর পর্যন্ত বজায় থাকে। ইঁদুরের উপর করা আগের গবেষণায় দেখা গিয়েছিল, কর্টেক্সে বার্তা পাঠানোর স্নায়ুতন্তুর মাধ্যমে থ্যালামাস শেখার ক্ষমতা বাড়াতে বা সীমিত করতে পারে। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে এই প্রভাব আগে পরীক্ষা করা হয়নি। তাই দলটি শিশু ও কিশোরদের মস্তিষ্কে থ্যালামাস ও কর্টেক্সের সংযোগের কাঠামোটি পরীক্ষা করেন। এর জন্য তারা ব্যবহার করেছেন ডিফিউশন এমআরআই। এ একটি নিরাপদ, অপেক্ষাকৃত মৃদু প্রযুক্তি, যা মস্তিষ্কে তরলের অণুসমূহের গতিপ্রকৃতি মেপে স্নায়ুতন্তুর মানচিত্র তৈরি করে। তা থেকে বোঝা যায় কোন অঞ্চল কোনটির সঙ্গে যুক্ত। গবেষণায় অংশ নেন ৮–২৩ বছর বয়সী প্রায় ২,৬০০ জন তরুণ। তাদের তিনটি ভিন্ন দলে ভাগ করা হয়। ১) ফিলাডেলফিয়ার প্রতিনিধিত্বমূলক কমিউনিটি নমুনা (১,১৪৫ জন), ২) যুক্তরাষ্ট্রের চার রাজ্যের স্বাভাবিক বিকাশমান তরুণ (৫৭২ জন), ৩) নিউ ইয়র্ক সিটির মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যায় ভোগা তরুণ (৯৫৯ জন)। গবেষকদের তৈরি নতুন থ্যালামাস- কর্টেক্স সংযোগ মানচিত্রে ২০০-রও বেশি স্নায়ু সংযোগ চিহ্নিত হয়। এই মানচিত্রটি দুটি অঞ্চলের মধ্যেকার সংযোগের ধরণ এবং শক্তি পরিমাপ করে। ড. সিডনার বলেন, “আমাদের তথ্য দেখাচ্ছে, থ্যালামাস শুধু তথ্য লেনদেনের কেন্দ্র নয়। কোন কর্টিকাল অঞ্চল কবে নমনীয় বা অভিযোজ্য থাকবে, সেটিও সে ঠিক করতে পারে।” গবেষণায় দেখা যায়, থ্যালামাস-কর্টেক্স সংযোগের পরিপক্বতা একটি বিশেষ ক্রম মেনে চলে। শিশুর মস্তিষ্কে যে অঞ্চল যত দেরীতে থ্যালামাসের সঙ্গে দৃঢ় সংযোগ গড়ে তোলে, সেই অঞ্চল ততদিন শেখার ক্ষমতা ধরে রাখে। এটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ কর্টেক্সের বিকাশের গতি বোধবুদ্ধিগত ও মানসিক স্বাস্থ্যের ফলাফলের সঙ্গে যুক্ত। যারা দীর্ঘ সময় ধরে বিকাশমান থ্যালামাসের সঙ্গে সংযোগ রাখে, তাদের মস্তিষ্কের অনুষঙ্গী অঞ্চলগুলোতে কিশোর বয়স পর্যন্ত নমনীয়তা বজায় থাকে। এটি জটিল চিন্তাভাবনা, সামাজিক দক্ষতা ও আবেগ প্রক্রিয়ায় সহায়ক। শুধু তাই নয়, যে সংযোগগুলি দীর্ঘ সময় ধরে বিকাশ লাভ করে, সেগুলি পরিবেশের প্রভাবে বেশি বদলায়। অর্থাৎ, দীর্ঘস্থায়ী নমনীয়তা পরিবেশ-সংবেদনশীলতা বাড়ায়। ভালো পরিবেশ, যেমন মানসিকভাবে সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা, সামাজিক সহায়তা, এই সংযোগ মজবুত করতে পারে। অন্যদিকে খারাপ পরিবেশ ক্ষতি করতে পারে। এই জ্ঞান ব্যবহার করে শিশু ও কিশোরদের মস্তিষ্কের উন্নততর স্বাস্থ্যকর বিকাশ ঘটানো যেতে পারে। সমৃদ্ধ পরিবেশ তৈরি করে থ্যালামাস-কর্টেক্স সংযোগকে শক্তিশালী করলে শেখার ক্ষমতা, মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা ও জটিল মানসিক দক্ষতা বাড়তে পারে। ড. সিডনার বলেন, “আমরা এখন জানতে চাই, অনুষঙ্গ বা অ্যাসোসিয়েশন অঞ্চলের নমনীয়তা বাড়ানোর নিয়ামকগুলো ঠিক কী, এবং কোন কোন পরিবেশগত উপাদান এই সংযোগকে দীর্ঘমেয়াদি শক্তিশালী করতে পারে।” কাজেই, থ্যালামাস যেন ঘড়ির কাঁটা মাপছে : কোন মস্তিষ্ক অঞ্চল কবে অভিযোজনশীল থাকবে। আর তার মধ্যেই পরিবেশের ছোঁয়ায় গড়ে উঠছে আমাদের শেখার ও মানিয়ে নেওয়ার দক্ষতা।

 

সূত্র : Human thalamocortical structural connectivity develops in line with a hierarchical axis of cortical plasticity by

Valerie J. Sydnor, et.al ; Nature Neuroscience (4th July, 2025)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

eight + 9 =