দশ-ভিত্তিক সংখ্যাপ্রণালীর ইতিহাস

দশ-ভিত্তিক সংখ্যাপ্রণালীর ইতিহাস

মীরা নন্দা
আই আই এস ই আর, মোহালির বিজ্ঞানের ইতিহাসের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক
Posted on ৪ এপ্রিল, ২০২৫

যতই পিছনদিকে যাই ততই দেখতে পাই ভারতীয়রা গণন-ক্রিয়ার একটি দশ-ভিত্তিক পদ্ধতি ব্যবহার করেছে। ঋক্‌ বেদ আর যজুর্বেদ থেকে যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় যে আদি বৈদিক যুগেই সংখ্যা গণনার এক নিয়মবদ্ধ দশ-ভিত্তিক প্রণালী বেশ ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল। বৈদিক সাহিত্যের যেসব শ্লোকে ১০-এর বিভিন্ন ঘাত-কে ব্যবহার করা হয়েছিল, কিম প্লফকার তার চমৎকার অনুবাদ করে দিয়েছেন। তা থেকে দুটি প্রতিনিধি স্থানীয় শ্লোকের অনুবাদ নীচে তুলে দিলাম : ১) ‘হে অগ্নি, আপনিই যাবতীয় [নৈবেদ্যর] পতি, আপনিই সহস্র সহস্র, শত শত, দশক দশক [সুসামগ্রীর] বিতরণকর্তা’। (ঋক্‌ বেদ, ২.১.8) ২) ‘হে ইন্দ্র, আসুন, কুড়িটি, ত্রিশটি, চল্লিশটি অশ্ব নিয়ে অবতীর্ণ হোন; আপনার রথের জোয়ালে বাঁধা পঞ্চাশটি, ষাটটি, সত্তরটি অশ্ব নিয়ে এসে সোমরস পান করুন; আশিটি, নব্বইটি, এবং একশোটি অশ্ববাহিত হয়ে অবতীর্ণ হোন’। (ঋক্‌ বেদ, ২,১৮ঃ৫-৬) ।
মধ্য-বৈদিক যুগে অনেক বড়ো বড়ো ঘাতযুক্ত সংখ্যার শব্দরূপ দেখতে পাই। যেমন যজুর্বেদ-এর (৭,২,২০) একটি পদ্যরচনায় অভিনন্দন জানানো হয়েছে বিভিন্ন সংখ্যাকে, যেগুলি এক, দুই, তিন থেকে শুরু করে অযুত (দশ হাজার), প্রয়াত (দশ লক্ষ), অর্বুদ (এক কোটি), ন্যর্বুদ (দশ কোটি), সমুদ্র (একশো কোটি), মধ্য (হাজার কোটি), অন্ত (দশ হাজার কোটি) এবং পরার্ধ (ট্রিলিয়ন = ১০^১২) পর্যন্ত বিস্তৃত’।
এসবই নিঃসংশয়ে প্রমাণিত। এগুলি নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। কিন্তু দশের বান্ডিল বা গুচ্ছ ধরে গণনা করার প্রচলন বিশ্বে এতই ব্যাপক ছিল যে সেটাকে কার্যত বিশ্বজনীন বলা যায়। যেমন, আমেরিকার আদি ভূমিসন্তানদের মধ্যে প্রচলিত ৩০৭টি সংখ্যা-পদ্ধতি নিয়ে বিশ শতকের প্রথম কয়েক দশকে যে-মানববৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান চালানো হয়েছিল তার মধ্যে ১৪৬টি ছিল দশ-ভিত্তিক; আর তাদের মধ্যে ১০৬টিতে ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করা হত ৫ কিংবা ২০। তাছাড়া, জর্জ ইফ্‌রা দেখিয়েছেন, দশের গুচ্ছ হিসেবে গণনা করা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর সবকটি সদস্যের মধ্যেই প্রচলিত ছিল। উক্ত ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত নিয়মটা ছিল এইরকম : “১ থেকে ৯ পর্যন্ত সংখ্যাগুলির এবং ১০-এর প্রতিটি ঘাতের (১০০, ১০০০, ১০০০০ ইত্যাদি) আলাদা আলাদা নাম ছিল আর বাকি সংখ্যাগুলি সবই ওইসব নামের বিশ্লেষণাত্মক সমাহার হিসেবে ব্যক্ত হত”। দশ-ভিত্তিক গণনাপদ্ধতির প্রায় বিশ্বজনীন প্রচলনের কথাটা মনে রাখলে ভারতীয়রা এ বিষয়ে অজ্ঞ ছিল একথাটা আশ্চর্যজনক।
দশ-ভিত্তিক সংখ্যায়নে ভারতের অগ্রাধিকারের দাবিটির ভিত হল গ্রন্থাকারে লিখিত সাক্ষ্য; গ্রীস আর চীন থেকে প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য থেকেও কিন্তু ব্যবহারিক উদ্দেশ্যসাধনে দশ-ভিত্তিক ব্যবস্থার প্রয়োগের কথা জানা যায়। খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০ সালে খোদিত সামোস দ্বীপের একটি সুড়ঙ্গর দেওয়ালে খোদাই করা আছে গ্রীক সাক্ষ্যটি। রাজধানীর বাইরে অবস্থিত একটি ঝরনা থেকে জল প্রবাহিত করবার জন্য সুড়ঙ্গটি খোঁড়া হয়েছিল। আধুনিক প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানকার্য থেকে জানা গেছে, দুটি দল দুই প্রান্ত থেকে সুড়ঙ্গটি খুঁড়তে খুঁড়তে অবশেষে মাঝামাঝি জায়গায় এসে মিলিত হয়েছিল। দেওয়ালে উৎকীর্ণ সংখ্যাগুলি এইরকম: দক্ষিণ প্রবেশমুখ থেকে “১০, ২০, ৩০, … ২০০” আর উত্তর প্রবেশমুখ থেকে “১০, ২০, ৩০ … ৩০০”। এগুলির সাহায্যে কতখানি দূরত্ব খোঁড়া হল তার হিসেব রাখা হত।

চীনের কথা যদি বলি, লিখিত আকারে চীনের সংখ্যায়ন পদ্ধতি দশের ঘাতের ওপর নির্ধারিত ছিল ঠিকই, কিন্তু সেটা স্থান-মূল্য নয়। অন্যদিকে চীনের মানুষ গণন-কাঠির সাহায্যে হিসাবক্রিয়া সম্পাদন করত, আর সেটার মধ্যে তো অবশ্যই দশ-ভিত্তিক স্থান-মূল্য ব্যবস্থার প্রয়োগ ঘটত। আজাকের দিনে আমরা যে-“হিন্দু-আরবি” সংখ্যাচিহ্ন ব্যবহার করি তার সঙ্গে চীনের এই ব্যবস্থা ধারণাগতভাবে সদৃশ। চীনের সংখ্যা-প্রণালী সম্বন্ধে প্রাচীনতম সাক্ষ্যপ্রমাণটি পাওয়া যায় তথাকথিত “দৈববাণী অস্থিপুঞ্জ” থেকে। সেখানে সুদূর খ্রিস্টপূর্বাব্দ ১৫০০ থেকে হাড় আর কচ্ছপের খোলার ওপর উৎকীর্ণ আছে রাজকীয় গণনার খতিয়ান। এই হাড়গুলির ওপর খোদাই করা আছে হিসেব – কত খাজনা জমা পড়েছে, কতগুলো পশু শিকার করা হয়েছে, কতগুলো পশু বলি দেওয়া হয়েছে, দৈব ভবিষ্য-গণনা সংক্রান্ত অন্যান্য বিবিধ রাশি। এই ‘দৈববাণী অস্থিপুঞ্জ’ গণিতের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এ থেকে এক উন্নত সংখ্যা-প্রণালীর পরিচয় ফুটে ওঠে, যার সাহায্যে যত বড়ো হোক যেকোনো সংখ্যাকে নয়টি একক-চিহ্ন সহযোগে প্রকাশ করা সম্ভব। শুধু সংখ্যা নয়, কতকগুলি নির্বাচিত “ঘাত-চিহ্ন”র সাহায্য নিয়ে ১০, ২০, ১০০, ১০০০-র ঘরের ঘাতগুলিকে সূচিত করা যায়। আজকের চীনে ব্যবহৃত মান্য সংখ্যা-প্রণালীটি এই প্রাচীন শাং প্রণালীরই সাক্ষাৎ উত্তরসূরি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

14 − two =