দানব বনমানুষের বিলুপ্তি রহস্য 

দানব বনমানুষের বিলুপ্তি রহস্য 

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ৩১ ডিসেম্বর, ২০২৫

পৃথিবীর বিবর্তনী ইতিহাসে জাইগ্যান্টোপিথেকাস ব্ল্যাকি এক ব্যতিক্রমী নাম। ইতিহাসে যত প্রাইমেট বা বনমানুষের অস্তিত্ব জানা যায়, তাদের মধ্যে আকারে সবচেয়ে বিশাল ছিল এই জাইগ্যান্টোপিথেকাস ব্ল্যাকি। প্রায় ২০ লক্ষ বছর ধরে এই দৈত্যাকার বনমানুষ দক্ষিণ চীনের ঘন অরণ্যে বিচরণ করেছিল। উচ্চতায় প্রায় ৬ থেকে ১০ ফুট এবং ওজনে প্রায় ২৫০ কিলোগ্রাম—এত বড় প্রাইমেট আর কখনও পৃথিবীতে দেখা যায়নি। কিন্তু এত বিশাল আকার সত্ত্বেও প্রজাতিটি আজ সম্পূর্ণ বিলুপ্ত। আর সেই বিলুপ্তির কারণ দীর্ঘদিন ধরে জীবাশ্মবিদ্যার অন্যতম বড় প্রশ্ন হয়ে ছিল।

প্লাইস্টোসিন যুগে, দক্ষিণ চীনের ঘন বনাঞ্চলে তাদের বসবাসের অস্তিত্বের প্রধান প্রমাণ মিলেছে গুহা থেকে উদ্ধার করা দাঁত ও চোয়ালের জীবাশ্মে। আশ্চর্যের বিষয় হলো—একই সময়ে এশিয়ার অন্যান্য বৃহৎ বনমানুষ, যেমন-ওরাংওটাং, টিকে গেলেও জি.ব্ল্যাকি কেন হারিয়ে গেল ? এই বৈপরীত্যই গবেষকদের আরও গভীর অনুসন্ধানে উদ্বুদ্ধ করেছে।

সাম্প্রতিক এক আন্তর্জাতিক গবেষণায় দক্ষিণ চীনের গুয়াংশি প্রদেশের ২২টি গুহা থেকে সংগৃহীত নমুনা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। একাধিক আধুনিক বয়স নির্ণায়ক পদ্ধতি ব্যবহার করে গবেষকরা নিশ্চিত করেছেন যে জি.ব্ল্যাকি প্রায় ২৯৫,০০০ থেকে ২১৫,০০০ বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে যায়। যা পূর্ববর্তী অনুমানের তুলনায় আরও আগের সময়কাল নির্দেশ করে।

দাঁতের ক্ষয়রূপ, রাসায়নিক উপাদান এবং মাইক্রোওয়্যার বিশ্লেষণ থেকে জানা যায়, এই প্রজাতিটি ছিল বিশুদ্ধ উদ্ভিদভোজী। বাঁশ, ফল এবং শক্ত উদ্ভিদ ছিল এর প্রধান খাদ্য। শক্তিশালী চোয়াল ও বৃহৎ মোলার দাঁত এই খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে সুস্পষ্টভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তবে এই বিশেষায়নই শেষ পর্যন্ত প্রজাতিটির অভিযোজন ক্ষমতাকে সীমিত করে দেয়।

প্লাইস্টোসিন যুগের শেষভাগে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দক্ষিণ চীনের বনভূমি ক্রমশ সংকুচিত হতে থাকে এবং তৃণভূমির বিস্তার ঘটে। বননির্ভর খাদ্য কমে যাওয়ায় জি.ব্ল্যাকি কম পুষ্টিকর বিকল্প খাদ্যের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হয়। এর পরিণামে শক্তির ঘাটতি, চলাচলের সীমাবদ্ধতা এবং দীর্ঘমেয়াদি শারীরবৃত্তীয় চাপ দেখা দেয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জনসংখ্যা হ্রাস পেতে পেতে প্রজাতিটি অবশেষে বিলুপ্ত হয়ে যায়।

মানুষ এই অঞ্চলে আসার আগেই জাইগ্যান্টোপিথেকাস ব্ল্যাকি হারিয়ে গিয়েছিল। তাই মানুষের শিকার এর জন্য দায়ী নয়। বরং অভিযোজনের অভাবই বিলুপ্তির প্রধান কারণ বলে প্রতীয়মান হয়। এই ঘটনাটি অতীতের এক জীবাশ্ম-রহস্যের সমাধান দেওয়ার পাশাপাশি বর্তমান বিশ্বের জীববৈচিত্র্য সংকটের প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা প্রদান করে।

 

সূত্র: The demise of the giant ape Gigantopithecus blacki by Yingqi Zhang, Kira E. Westaway, et.al;published in Nature journal, 26th December 2025.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

three × 5 =