দিবালোকে আকাশে মহাবিস্ফোরণ

দিবালোকে আকাশে মহাবিস্ফোরণ

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ৬ নভেম্বর, ২০২৫

প্রায় ১০,০০০ আলোকবর্ষ দূরে, আকাশগঙ্গার গভীরে এক জোড়া তারা নিজেদের মধ্যে বুনে চলেছে এক ভয়ংকর ধ্বংসলীলার জাল। এই তারকাযুগলের নাম ভি স্যাজিটা। 1902 সালে প্রথম আবিষ্কার হওয়ার পর থেকেই এটি জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কাছে এক বিস্ময়। এটি এক “দ্বৈত তারকা ব্যবস্থা”। এখানে দুটি তারা একে অপরের চারপাশে ঘুরছে, এবং গ্রহীতা তারাটি অপর দাতা তারাটির জীবনশক্তি শুষে নিচ্ছে। দাতা তারাটি সূর্যের চেয়ে প্রায় তিন গুণ ভারী, আর তার সঙ্গী তারাটি এক রহস্যময় মরনোন্মুখ দানব তারকা, যা মহাবিশ্বের সবচেয়ে উত্তপ্ত ও অস্থির তারাগুলোর একটি। এটি তার সঙ্গীর হাইড্রোজেন স্তরগুলো টেনে নিচ্ছে ভীষণ বেগে এবং সেই গ্যাস শোষণ করে নিজের চারপাশে গড়ে তুলেছে এক আগুনের ঘূর্ণিঝড়। যার ফলে তার চারপাশে একটি তীব্র উজ্জ্বলতা তৈরি হয়েছে। এই পদার্থ জমে জমে তারার পৃষ্ঠে তাপ-নিউক্লিয় বিক্রিয়া ঘটাচ্ছে, যা মাঝে মাঝে বিশাল আলোকিত বিস্ফোরণ ঘটায়, যাকে বলে নোভা। বিজ্ঞানীরা বলছেন দৃশ্যটি দেখে মনে হচ্ছে যেন একটা তারা অন্যটিকে গোগ্রাসে ভক্ষণ করছে। আপাত নির্মম মনে হলেও এর কিন্তু অপূর্ব সৌন্দর্য আছে।
সম্প্রতি রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির মাসিক নোটিসে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্র থেকে জানা গেছে, এই তারাযুগল ভবিষ্যতে এক প্রচন্ড সুপারনোভা বিস্ফোরণে ফেটে পড়বে। পৃথিবী থেকে দিবালোকেও খালি চোখে তা দেখা যাবে।
ইউরোপীয় দক্ষিণ মানমন্দিরের বৃহৎ টেলিস্কোপ এবং এক্স সুটার স্পেকটোগ্রাফের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা এই তারাটির আলোকবর্ণালী বিশ্লেষণ করেন। দেখা যায়, এর চারপাশে এমন কিছু গ্যাসীয় বিকিরণ আছে যা দুই তারার গতির সঙ্গে মেলে না। তাদের অনুমান, তারাযুগলের চারপাশে এক গ্যাসের বলয় রয়েছে। এটি তৈরি হয় যখন সাদা বামন তারা তার সঙ্গীর থেকে এত বেশি পদার্থ এত দ্রুত টানে যে সবকিছু গিলতে না পেরে ,ছিটকে গিয়ে পুরো সিস্টেমটিকে ঘিরে এক উজ্জ্বল আলোকমালা তৈরি করে।
গবেষক পাসি হাকালা বলেন, এই আলোকবৃত্ত দেখে মনে হয় যেন তারাদের এক অপরিষ্কার-অগোছালো ভোজ চলছে , আর অতিরিক্ত তাড়াহুড়া করে খেতে গিয়ে খেতে না পারা বাড়তি অংশগুলো যেন ছড়িয়ে পড়ছে আকাশে। অর্থাৎ, যেন এক তারকার ক্ষুধার্ত ভক্ষণযজ্ঞের ধোঁয়া।
ভি স্যাজিটার আলো কখনও হঠাৎ জ্বলে ওঠে, কখনও নিভে যায়। এই অস্থিরতা তার অন্তর্গত বিশৃঙ্খলার ইঙ্গিত। নতুন গবেষণায় ধারণা করা হচ্ছে, এই অস্থিরতার কারণ অভ্যন্তরীণ জলন্ত ঘূর্নায়মান পদার্থের চাকতির অবিন্যস্ত ঘূর্ণন ও কক্ষপথের ঢালের পরিবর্তন।
এই ঘূর্ণন কখনো দিন কয়েক স্থায়ী হয়, আবার কখনো বছর পর্যন্ত টিকে থাকে। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এই উন্মত্ত আচরণই প্রমাণ করছে—এই দোদুল্যমান তারকা যুগল নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তাদের চরম পরিণতির দিকে ছুটছে।
খুব শীঘ্রই, আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই এটি ঘটাতে পারে এক নোভা বিস্ফোরণ। তখন তারার জমা গ্যাস হঠাৎ প্রজ্জ্বলিত হয়ে আকাশে এক উজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে দেবে। শুধু তাই নয়, এক সময় দুটি তারা অবশেষে একে অপরের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হবে। তখন তাদের মিলিত ভর ও শক্তি ঘটাবে এক প্রচণ্ড সুপারনোভা বিস্ফোরণ। গবেষণাপত্রের সহ-লেখক স্পেনের ইনস্টিটিউট ডি অ্যাস্ট্রোফিসিকা ডি ক্যানারিয়াসের ড. রদ্রিগজ-গিল ও অন্যান্য জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, এই বিস্ফোরণের উজ্জ্বলতা এতটাই হবে যে পৃথিবী থেকে দিনের আলোতেও এটি দৃশ্যমান হবে। এ যেন অনেকটা মহাজাগতিক আতশবাজির মতো। যেখানে আকাশ জ্বলে উঠবে লক্ষ সূর্যের আলোক ছটায়। মানবসভ্যতার আকাশে এ হবে এক অমর দৃশ্য, যা আমাদের চোখের সামনেই মহাবিশ্বের সৃষ্টির ও ধ্বংসের অনন্ত চক্রের আরেক অধ্যায় উন্মোচন করবে।

সূত্র: “V Sge: supersoft source or exotic hot binary? – I. An X-Shooter campaign in the high state” by Pasi Hakala, Pablo Rodríguez-Gil,et.al;(13.08.2025), Monthly Notices of the Royal Astronomical Society.
DOI: 10.1093/mnras/staf1284

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

two × three =