দীপ্তিময় ক’রে এগিয়ে চলুক ডারউইন ভাবনা

দীপ্তিময় ক’রে এগিয়ে চলুক ডারউইন ভাবনা

অভিজিৎ চৌধুরী
Posted on ১০ এপ্রিল, ২০১৯
ডারউইন

বিজ্ঞানভাষের এই সংখ্যা ডারউইন ভাবনার। অবশ্যই এর উদ্দেশ্য পরমপূজ্যপাদ শ্রীমৎস্বামী ডারউইনকে পুজো করা নয়। চোখ বন্ধ ক’রে, ধূপধুনো দিয়ে সাজিয়ে বিজ্ঞান নামক বস্তুটিকেও স্রষ্টার অপরূপ কীর্তির মধ্যে একটি – এ’রকম একটা আবহ তৈরী করার সামগ্রিক চেষ্টার মধ্যে এ’দেশে আমরা প্রতিমুহূর্তে থাকি। ভক্তিরস দিয়ে বিজ্ঞানের ‘অপবিত্র’ অঙ্গনকে কীভাবে ধুয়ে মুছে সাফ করা যায়, তার ঢাকঢোল চারদিকে বাজছে। এর মধ্যেই এসে পড়েছেন ডারউইন – আমাদের জাগিয়ে তুলতে – ভাবাতে। তাই এই চেষ্টা।

একদিকে যুক্তি, অন্যদিকে প্রশ্নহীন আনুগত্য এবং বিশ্বাস – এই দুই পরস্পর-বিরোধী মানসিক প্রবৃত্তির মধ্যে ক্রিয়া–বিক্রিয়াই ঠিক ক’রে দেয় মানুষের ভাবনার গতিপথ। ভাবনার পথে আলো থাকবে, না কি জ্বলবে অন্ধকার (হ্যাঁ, পৃথিবী আলোর’ই – সেখানে আঁধার জ্বালানো হয়) – তা ঠিক হয় প্রবহমান সমাজের যুক্তি-নির্ভরতার ওপর। তথ্যসংগ্রহ, বিশ্লেষণ এবং তারপর সিদ্ধান্তে পৌঁছনো – ধাপে-ধাপে এগোয় বিজ্ঞান। আবার এগিয়েও পেছনপানে চায়। গৃহীত সিদ্ধান্তের ভিত্তি সঠিক কিনা বারবার পরখ ক’রে দেখে। ‘শাশ্বত-ভাবনা’, ‘পবিত্র-চিন্তা’ শব্দবন্ধগুলো বিজ্ঞানের জগতে আঁধার আনে। পুরোনো ভাবনা, নতুন তথ্য থেকে উঠে আসা তত্ত্বের আলোতে, বিজ্ঞান আরও সমৃদ্ধ হয়। চোখ বুজে সোজা পথে হাঁটা বিজ্ঞানের কাজ নয়। যা ভাবা হচ্ছে, তা ঠিক নয় কেন – এই প্রশ্ন বারবার উঠে আসে বিজ্ঞানের অঙ্গনে। ‘নিত্য’ ব’লে যা-কিছু আজ আছে – বিজ্ঞানের প্রমাণ উঠে আসার সাথে সাথে তাই হয়ে যায় – ‘অনিত্য’ – নতুন আলোর উন্মেষ ঘটে। আর বিশ্বাস ? প্রশ্ন তোলার ইচ্ছে পাপী-তাপীর কাজ, যুক্তি হচ্ছে অহংকারের ভড়ং, যা চলে আসছে ভাবনায় আর যুক্তিতে, তাকে নিঃসংকোচে গ্রহণ করা, প্রতিপালন করাটা’ই কাজ – এই তত্ত্ব অনুযায়ী। যুক্তির জাল-বিস্তারে বিশ্বাসীরা শঙ্কিত হন, প্রমাণের আবির্ভাবে তারা উত্তেজিত হ’ন, আর ‘নতুন ভাবনা’-র গন্ধ পেলেই তাকে তাড়া করেন। ‘বিশ্বাস’ সমাজতত্ত্বের হিসাবে সামন্তযুগের প্রধান স্তম্ভ। যুক্তি, প্রমাণ, বিজ্ঞান বিকাশশীল সমাজের পথচলার শব্দ। কাজেই নতুন চিন্তার আবির্ভাব, সনাতন স্রষ্টার গুণকীর্তনমূলক ভাবনা যখনই কোনো ভাবনায় আক্রান্ত হয় – তখনই বিশ্বাসের প্রবক্তারা জেগে ওঠেন। আর এরা যদি রাজনৈতিক ক্ষমতায় থাকেন – তা’হলে তো আক্রমণ হয় আরও জোরালো। এভাবেই যুগে যুগে ঘটেছে। জিওর্দানো ব্রুনো, গ্যালিলিও যে এভাবেই মুক্তচিন্তার ধ্রুবতারা হয়েছেন। ডারউইন’ও তাই।

এটা তাই একদমই অবাক নয় – যে ‘তিলকধারী’, ‘বিজ্ঞান’ শিক্ষক রাজনৈতিক নেতা ডারউইনকে তুলে ধ’রে আছাড় মারতে উদ্যত হবেন না। হয়েওছে তাই। আর আমরাও তাই বেরিয়ে পড়েছি ডারউইন-আন্দোলনে। স্রষ্টার অমোঘ সৃষ্টি মানুষ ভগবৎরূপী হনুমানের বংশধর ব’লে নাকি ডারউইন সাহেব বলে গেছেন। বজরংবালী বিজ্ঞানী নেতাদের কোপ সেই কারণেই। আর ঠিক এই সময়েই চীনা বিজ্ঞানীরা গবেষণাগারে বানিয়ে ফেলেছিলেন একদম দুটি বানর-শিশু। ‘ক্লোনিং’ যাকে বলে। চীন দেশে ঘটলেও এর প্রভাব বিজ্ঞানের চিন্তায় ব্যাপক। প্রশ্নটা হচ্ছে বানর বানানো কেন ? আগে তো ভেঁড়া বানানো হয়েছিল। কারণটা এই যে, ‘বিজ্ঞান’-এর চিন্তায় বানর নাকি মানুষের কাছাকাছি। চীনদেশ, আমাদের ‘বিজ্ঞানী শিক্ষামন্ত্রী’-র চৌহদ্দির মধ্যে নেই। কিন্তু ভাবনাটা তার কাছে ভয়ঙ্কর লাগতে পারে।

আর এখানেই ডারউইন ভাবনার প্রাসঙ্গিকতা। অন্ধকারাচ্ছন্নদের ভয় দেখিয়ে – আলোকে আরও দীপ্তিময় ক’রে এগিয়ে চলুক ডারউইন ভাবনা। আমরা সেই পথে পথিক হতে চাই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

15 − 10 =