দূষণে বিপর্যস্ত মাথাভাঙা নদী

দূষণে বিপর্যস্ত মাথাভাঙা নদী

সুদীপ পাকড়াশী
Posted on ৫ জুন, ২০২২

আদিবাসী অধ্যুষিত একটি গ্রাম চাঁদপুর। পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার কিষানগঞ্জ ব্লকে তার অবস্থান। গ্রাম থেকে মাত্র ৫০০ মিটার দূরে বাংলাদেশ সীমান্ত। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে মাথাভাঙা নদী। ভারত এবং বাংলাদেশ-দুই দেশের মধ্যে দিয়েই সে বয়ে যাচ্ছে। সাধারণত এরকম নদীকে ঘিরে গড়ে ওঠে এক আলাদা সভ্যতা। পাড়ের সভ্যতা। প্রচুর মানুষকে নদীর দু’কূল ধরে দেখা যায় ঘর বাঁধতে। তাদের অধিকাংশই মৎসজীবী হতে পারেন। কিন্তু চাষীর সংখ্যাও কম থাকে না এদের দলে। কৃষি জমিতে ছোট ছোট খাল কেটে নদী থেকে জল এনেই তো চলে চাষের কাজ।
কিন্তু মাথাভাঙা ব্যতিক্রমী এক নদী হয়ে গেল গত ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে। তথাকথিত ‘উন্নয়নশীল’ এবং চুড়ান্ত স্বার্থপর মানুষের প্রকৃতির প্রতি অপরিসীম অবহেলাই মাথাভাঙা নদীকে ব্যতিক্রমী হতে বাধ্য করল। নদীর জলকে মানুষ এত দূষিত করে দিল যে ওই অঞ্চলের মানুষের কাছে আজ দূষণের আর এক নাম মাথাভাঙা নদী! ভারতে নদীর জলকে দূষণের হাত থেকে বাঁচানোর লড়াই গত কয়েক দশক ধরে যে মানুষগুলো করে যাচ্ছেন তাদের পর্যবেক্ষণ জানিয়েছে মাথাভাঙা নদীর এভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ার সৌজন্যে রয়েছে বাংলাদেশের কিছু শিল্পগোষ্ঠী।
সেরকমই একজনের নাম বিনয় রাই। গবেষণাগারে নিয়ে গিয়েছিলেন মাথাভাঙা নদীর জল পরীক্ষা করাতে। সেখানে তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, জলটা কোনও ড্রেন থেকে তিনি নিয়ে গিয়েছেন কি না! সেন্ট্রাল পলিউশন কন্ট্রোল বোর্ড ২০১৮-য় পশ্চিমবঙ্গের ১৭টা নদীকে সর্বোচ্চ দূষণের তালিকায় রেখেছিল। সেই তালিকায় ছিল মাথাভাঙা, জলঙ্গি আর চূর্ণি। বোর্ডের দেওয়া পরিসংখ্যানে মাধপুর থেকে গোবিন্দপুর পর্যন্ত মাথাভাঙা নদীর টানা ৮০ কিলোমিটারে বায়োকেমিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড (বিওডি) ছিল ১০ থেকে ২০ মিলিগ্রাম! পরিবেশবিদরা যাকে বলছেন দূষণের উচ্চ স্তরে রয়েছে এই নদী। এ তো গেল কাগজে-কলমের হিসেব। কিন্তু বাস্তবের ছবিটা? দূষণ কোন পর্যায়ে গেলে তবেই না পাঁচ বছর ধরে নদীর কূলে সমস্ত চাষবাষ (মূলত গম আর চট) বন্ধ হয়! নদীর জল কত পরিমাণ দূষিত হলে তবেই বা মাছ চাষ বন্ধ হয়ে যায়! সব কিছু বন্ধ হয়ে গিয়েছে মাথাভাঙা নদীর জলে। পরিসংখ্যানের আশ্রয় নিলে জানা যাবে গত ১০ বছরে অন্তত ১০ হাজার মৎসজীবীর মাছ ধরার কাজ বন্ধ হয়ে গিয়েছে! তারা অন্যান্য পেশায় প্রবেশ কীভাবে দিন কাটাচ্ছেন সেই খোঁজ পরিবেশবিদরা রাখেননি। কেরু কোম্পানিও রাখেনি।
কেরু কোম্পানি কে? বাংলাদেশের সরকারি চোলাই মদ প্রস্তুতকারক সংস্থা। এই সংস্থা ১০০ রকমের প্রোডাক্ট তৈরি করে। তার মধ্যে বিদেশি মদও রয়েছে। কল্যাণীর এক নদী সংরক্ষণবিদ অনুপ হালদার। মাথাভাঙা নিয়ে তার গবেষণা জানাচ্ছে, ওই সংস্থার অব্যবহৃত শিল্পবর্জ্য মজুত করে রাখা হয় মাথাভাঙা নদীতেই। সেই বর্জ্য নদীর জলের মাধ্যমে ভারতে প্রবেশ করে অনায়াসে ঢুকে পড়ে ইছামতী এবং চূর্ণি নদীতে। সেখান থেকে বর্জ্য থেকে সৃষ্ট দূষণ প্রবেশ করে ভাগীরথীতে আর ইছামতীর জল দিয়ে ভেসে সেই দূষণের প্রবেশ হয় সুন্দরবনে। মাথাভাঙা নদীর দূষণে বিপর্যস্ত শুধু চাঁদপুর নয়,আশেপাশের অন্তত আরও সাত থকে আটটা গ্রামের মানুষও। তারা জানিয়েছেন, কয়েক বছর আগেও এই নদীতে চান করা যেত। কিন্তু এখন কোনও রাস্তার কুকুর বা অন্য প্রাণীও যদি এই নদীর জল খায় তাহলে সে মারাও যেতে পারে! এই প্রসঙ্গে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ এনভায়র্নমেন্ট স্টাডিজের অধ্যাপক তড়িৎ রায়চৌধুরীর বক্তব্য, “এই ধরনের আন্তঃসীমান্ত নদী কিন্তু দূষণবৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলতে পারে। ভূ-গর্ভস্থ জলের অত্যাধিক নিষ্কাশনের ফলে জলস্তর স্বাভাবিকভাবেই নীচে নেমে যায়। তখন সেই জলে ঢুকে পড়ে নদীতে জমে থাকা আর্সেনিক, ফ্লুরাইডের মত টক্সিক পলিউট্যান্টস।”
আনুপ হালদারই হয়ত সঠিক মূল্যায়ন করেছেন মাথাভাঙা নদীর। বলেছেন, “সরকারি ঔদাসীন্য, অবহেলা আর মানুষের অসচেতনতার প্রতিফলনে ভারতে গত ৭৫ বছরে ১০০টা নদীর বিলুপ্তি হয়ে গিয়েছে। মাথাভাঙা আর চূর্ণিকে নিয়ে যেরকম ঔদাসীন্য দেখা যাচ্ছে তাতে এই দুটো নদীও হয়ত একদিন সম্পূর্ণ বুঁজে যাবে। কেউ মনেও রাখবে না।”