নগরায়ন ও পতঙ্গ জীবন সংকট

নগরায়ন ও পতঙ্গ জীবন সংকট

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২১ আগষ্ট, ২০২৫

নগরায়ন ভেতরে ভেতরে ডেকে আনছে এক বিপর্যয়। শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এর সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, শহরাঞ্চলে পরাগবাহী পতঙ্গের প্রজাতি গড়ে ৪৩ শতাংশ কমে গেছে। এই পতঙ্গদের সংখ্যা হ্রাস শুধু প্রাকৃতিক পরিবেশে নয়, কৃষিক্ষেত্র তথা সমগ্র বাস্তুতন্ত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
গবেষকরা শেফিল্ড, লিডস ও লিস্টারের বিভিন্ন বাগান থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছেন। তাঁরা দেখেন শহরের একেবারে কেন্দ্রগামী এলাকাগুলোতে পরাগবাহী পতঙ্গের প্রাচুর্য ও বৈচিত্র্য সবচেয়ে কম। শুধু মৌমাছিই নয়, প্রজাপতি, মথ ও হোভারফ্লাইয়ের মতো অন্যান্য পতঙ্গগুলিও নগর উন্নয়নের বড় শিকার। তবু মৌমাছিরা তুলনামূলকভাবে শহরে টিকে থাকতে পারে, কারণ তাদের প্রয়োজন ফুল—যা শহুরে সবুজ এলাকাগুলোয় রয়েছে। বিশেষ করে সামাজিক মৌমাছিরা, যেমন মধুমক্ষিকা ও ভ্রমর, এ পরিবেশে সাধারণত টিকে যেতে পারে অনেক দূর থেকে উড়ে গিয়ে খাবার সংগ্রহ করার ক্ষমতা থাকায়। কিন্তু হোভারফ্লাই ও মথদের টিকে থাকার জন্য দরকার গাছপালা, নির্দিষ্ট প্রজনন পরিবেশ এবং বিশেষ গাছের উপস্থিতি—যা শহরের কংক্রিটঘেরা পরিবেশে উত্তরোত্তর হারিয়ে যাচ্ছে।
গবেষণায় দেখা যায়, আধা-প্রাকৃতিক এলাকা ও গাছপালায় সমৃদ্ধ স্থানগুলোতে এই পতঙ্গদের টিকে থাকার সম্ভাবনা অনেক বেশি। বিশেষ করে মথদের ক্ষেত্রে গাছের ছায়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে, শহরের বাগানগুলো সব সময় কার্যকর নয়, কারণ অনেক বাগানেই শুধুই থাকে ঘাস বা অপ্রয়োজনীয় সুদৃশ্য উদ্ভিদ। শহর মূলত এক ধরনের প্যাঁচানো মানচিত্র যেখানে সিমেন্টের তৈরি রাস্তা, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সবুজ এলাকা, আর বিচ্ছিন্ন বাসস্থান একসাথে মিশে থাকে। এই বিচ্ছিন্নতা ও অপ্রতুল সবুজ অঞ্চল পতঙ্গদের জীবন কঠিন করে তোলে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, যত ঘনবসতি, তত কম পোকা।
মথ ও হোভারফ্লাইয়ের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি কমে যায় শহরের কেন্দ্রের কাছাকাছি এলাকাগুলোতে। ১০% কংক্রিট বৃদ্ধিতে পতঙ্গ প্রজাতি ৭.৫% পর্যন্ত কমে যেতে পারে। এর মূল কারণ হল শহরের ব্যস্ত ঘনবসতিপুর্ণ অঞ্চলগুলিতে গছপালা কম, জলাভূমি নেই, যা পতঙ্গদের টিকে থাকার পরিবেশ হিসেবে খুবই দুর্বল।
আমরা অনেকেই ভাবি, পতঙ্গরা কেবল ফুলে ফুলে উড়ে পরাগায়ন করে। কিন্তু আসলে তাদের ভূমিকা অনেক বড়। যেমন, হোভারফ্লাইয়ের লার্ভা ফসল ধ্বংসকারী এফিড বা ছোট পোকা খেয়ে ফসল রক্ষা করে। মথ মৃত গাছপালা খেয়ে পুষ্টির পুনর্ব্যবস্থাপনায় সাহায্য করে। আবার মথকে খায় পাখি ও বাদুড়, অর্থাৎ তারা খাদ্যচক্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ফলে মথ ও হোভারফ্লাইয়ের বিলুপ্তি পুরো বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে। শিকার কমে যায়, পুষ্টিচক্র ভেঙে পড়ে, এবং প্রাকৃতিকভাবে ফসলের পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ ব্যাহত হয়।
এই সংকট মোকাবিলায় শুধু ফুলগাছ লাগানো যথেষ্ট নয়। শহরগুলোর প্রয়োজন কাঠামোগত ও পরিবেশবান্ধব পরিকল্পনা- বৃক্ষরোপণ, জলাধার সংরক্ষণ, প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা এবং পতঙ্গদের জন্য উপযুক্ত আশ্রয় তৈরির ব্যবস্থা। পতঙ্গেরা আমাদের বহুবিধ উপকার করে , এখন আমাদের সময় এসেছে ওদের রক্ষা করার। নইলে, ভবিষ্যতের খাদ্যনিরাপত্তা ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

সূত্র: Drivers of nocturnal and diurnal pollinating insect declines in urban landscapes by Emilie E. Ellis, et.al ; Proceedings of the Royal Society B (Biological Sciences)(6.08.2025).

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

five × 5 =