রাধাগোবিন্দ কর। বাংলার এক কিংবদন্তি চিকিৎসক। ১৮৫০-এ জন্ম, ১৯১৮-য় মৃত্যু। সাধারণ মানুষের স্মৃতিতে আজ তার কর্মকাণ্ড হয়ত ম্লান হয়ে গিয়েছে। যদিও প্রত্যেকদিন এই শহর, এই রাজ্যের কয়েক লক্ষ মানুষকে তার নাম একবার উচ্চারণ করতেই হয়! আর.জি.কর হাসপাতাল যে তার উদ্যোগেই তৈরি হয়েছিল ১৯১৬-র ৫ জুলাই সেই কথা সাধারণ মানুষ আজ মনে রেখেছে কি না কে জানে!
এক বিরল মুকুট ছিল তার প্রাপ্তির ঝুলিতে। ভগিনী নিবেদিতার সঙ্গে রাস্তায় নেমে ১৮৯৯-এর মার্চে উত্তর কলকাতায় ঘুরে ঘুরে প্লেগ রোগীদের সেবা করেছেন রাধাগোবিন্দ কর। চিকিৎসাবিজ্ঞানের মানুষ তিনি। সেই সময় ছিলেন জেলার স্বাস্থ্য আধিকারিক পদে নিয়োজিত ডাক্তার। তাই রোগীর সেবা করা তার কাছে হয়ত স্বাভাবিক। কিন্তু গিরিশ ঘোষের সঙ্গে নাটক করা? সে তো কম বড় প্রাপ্তি নয়! ডাক্তারি পড়ার পাশাপাশি সমানতালে নাটক করে গিয়েছেন তিনি। ১৮৬৮-তে বাগবাজার অ্যামেচার থিয়েটার তৈরি করেছিলেন রাধাগবিন্দ। সেখানে নাটক করা অন্যতম অভিনেতা কিংবদন্তি গিরিশ ঘোষ! বাবার বন্ধু ছিলেন বিখ্যাত নাটকার দীনবন্ধু মিত্র। সেই সুবাদেই রাধাগোবিন্দের নাট্যজগতে পা রাখা। দীনবন্ধু মিত্রের লীলাবতী নাটকে ক্ষিরোদবাসিনী-র ভূমিকার অভিনয় করে যথেষ্ঠ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন রাধাগোবিন্দ।
হাওড়া জেলার রামরাজাতলায়, বেতড় গ্রামে রাধাগোবিন্দ করের আদি বাড়ি। সেই বাড়ি তৈরি হয়েছিল পলাশির যুদ্ধের আগের বছর! সেখানেই রাধাগোবিন্দের জন্ম। যে দালানে তার জন্ম হয়েছিল সেটি আজ ভগ্নদশায়। বছর তিন আগেও কেউ জানতেন না সেটা। একটা ধারণা তৈরি হয়েছিল যে, কিংবদন্তি ডাক্তারের জন্ম হয়েছিল বাংলাদেশে। তিন বছর আগে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজেরই দুই চিকিৎসক খুঁজে খুঁজে বেতড়ে পৌঁছন। তারপর থেকে তার সম্পর্কে তারই সৃষ্ট হাসপাতালের চিকিৎসকদের মধ্যে এবং একইসঙ্গে সরকারের মধ্যেও কিঞ্চিৎ আগ্রহ দেখা যায়।
নাটক ছেড়ে রাধাগোবিন্দের সম্পূর্ণভাবে ডাক্তারিতে মনোনিবেশ করার পেছনে দুটো ঘটনা ছিল। ১৮৭৯-তে একবার বিনা দোষে রাধাগোবিন্দকে পুলিশের হাতে নিগৃহীত হতে হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, এই সময়েই ছাত্রাবস্থায় বিয়ে করা রাধাগোবিন্দের প্রথম পত্নীর প্রয়াণ হয়। তারপই চিকিৎসা ও মানুষের সেবায় নিজেকে পুরোপুরিভাবে নিবেদিত করেন রাধাগোবিন্দ। মাতৃভাষায় ডাক্তারি পড়ার শিক্ষাও তার হাতেই শুরু। শিধু তাই নয়, ইংরেজদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে সম্পূর্ণ আলাদা এক মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল গড়ার নিঃশব্দ শপথ তখনই রাধাগোবিন্দ নিয়েছিলেন। কারণ চোখের সামনে তিনি দেখতেন দিনের পর দিন ইংরেজদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজে ভারতীয় রোগীদের প্রতি চিকিৎসার নামে কীরকম উপেক্ষা, অবহেলা সহ্য করতে হচ্ছে! কিন্তু ব্রিটিশ শাসনের মধ্যে আলাদা মেডিক্যাল কলেজ আর হাসপাতাল গড়ার কাজ তো সহজ নয়। প্রায় গন্ধমাদন পর্বত তুলে আনারই মত! কিন্তু দুঃসাধ্য কাজ দমাতে পারেনি রাধাগোবিন্দকে। পুরনো বৈঠকখানা বাজারে ১৬১ নম্বর বাড়িতে রাধাগোবিন্দ সেই সময়ের কলকাতার সেরা কয়েকজন ডাক্তারকে নিয়ে একটা সংগঠন তৈরি করেন। সংগঠনের সদস্য ছিলেন মহেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, অক্ষয়কুমার দত্ত, বিপিন মিত্র, কুমুদ ভট্টাচার্যের মত বিখ্যাত ডাক্তাররা। এই সমিতিই এশিয়ায় প্রথম তৈরি করেছিল বেসরকারি স্কুল। ১৮৮৬-তে পথ চলা শুরু সেই ক্যালকাটা স্কুল অফ মেডিসিনের। বাংলায় লেখা চিকিৎসা বিজ্ঞানের বই ওখানে পড়ানো হত। তার কয়েক বছর পর স্কুল কর্তৃপক্ষ বেলগাছিয়ায় ১২ বিঘে জমি কিনে স্কুলের নিজস্ব বাড়ি তৈরি করে। ১৮৯৯-এ স্কুল সংলগ্ন হাসপাতালও তৈরি হয়। জন উডবার্ন উদ্বোধন করেন হাসপাতালের।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ক্যালকাটা মেডিক্যাল স্কুলের নাম বদলে রাধাগোবিন্দ করের নামে রাখা হয়েছিল। ১৯৪৮-এ এই হাসপাতালের নাম বদলে ফেলতে চেয়েছিল এক ধনী ব্যক্তি। কয়েক লক্ষ টাকা অনুদান দিয়ে। কিন্তু তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ও আর এক কিংবদন্তি চিকিৎসক বিধান রায় সেই উদ্যোগ বন্ধ করে দেন। কারণ হাসপাতালের নাম যে রাধাগোবিন্দ করের নামেই হবে সেই বিষয়ে তিনি অনড় ছিলেন! গুণীর সম্মান গুণীই দেয়!