নিয়ম ভাঙা পোকার দল

নিয়ম ভাঙা পোকার দল

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা‌
Posted on ২৪ জানুয়ারী, ২০২৪

পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘোরার সাথে সাথে আমাদের শারীরবৃত্তীয় ঘড়িও ঘোরে। এই ঘড়ি অনুযায়ী মানুষ সহ বেশ কিছু প্রাণীর রাতে ঘুমিয়ে পড়ার কথা। আবার বাঘ, সিংহ, শেয়াল, বাদুড়ের মতো প্রাণীদের জীবন ঘড়ির কাঁটা চলে আমাদের বিপরীতে। এরা রাতে জাগে, দিনে ঘুমোয়। এককোষী প্রাণী থেকে শুরু করে এই সবুজ গ্রহের সবচেয়ে বুদ্ধিমান জীব হোমো সেপিয়েন্স, বিশ্বের সমস্ত প্রাণীর শারীরবৃত্তীয় কাজকর্ম চলে এক নির্দিষ্ট ছন্দে। এরই নাম ‘বায়োলজিক্যাল ক্লক’ অর্থাৎ ‘জীবন ঘড়ি’, বিজ্ঞানীরা বলেন ‘সার্কাডিয়ান রিদম’। এটি আদতে একটি শরীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া, যা প্রতি ২৪ ঘণ্টায় সম্পূর্ণ হয়। অনেকটা পৃথিবী যেমন নিজের কক্ষে ঘোরে, সেই রকমই প্রাণীদের অস্তিত্বকে এক অদৃশ্য ছন্দে বেঁধে দেয় এই প্রক্রিয়া। বিজ্ঞানীদের ধারণা, পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টির সময় থেকেই এই জীবন ঘড়ি চালু হয়েছে।
আমাদের শরীরে এমন কিছু অণু রয়েছে যা কখনো একা একা বা কখনো সেক্স হরমোনের সহায়তায় দিনের আলোর সাথে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের শরীরে এক নির্দিষ্ট তালে নেচে চলে। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্বে এক গবেষণায়, ডেভিস দেখিয়েছেন এই সময় নিয়ন্ত্রক অণুগুলো কোনো ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভিন্ন সুরে নাচছে। বড়ো বড়ো কালো শ্যাফার বিটলে (হোলোট্রিচিয়া প্যারালেলা), সেক্স হরমোনের নেতৃত্ব একটি অভ্যন্তরীণ ছন্দ তৈরি করে যা সাধারণত ২৪-ঘন্টা ঘড়ির পরিবর্তে ৪৮-ঘন্টার ছন্দে চলে। এই অদ্ভুত অভ্যন্তরীণ ঘড়িটি সার্কাডিয়ান চক্র শুরু এবং শেষ করতে প্রায় দ্বিগুণ সময় নেয়, তাই একে বলে ‘সার্কাবিডিয়ান’ রিদম। প্রকৃতিতে ৪৮-ঘন্টা ছন্দের জীবন ঘড়ি বিরল। এশিয়া মহাদেশে এই পোকাটি শস্যের ক্ষতি করার জন্য বেশ কুখ্যাত। স্ত্রীপ্রজাতির বিটল প্রতি এক রাত অন্তর মাটির উষ্ণতা ছেড়ে হাওয়ায় বেশ খানিকটা উড়তে উড়তে তার পুরুষ সঙ্গীকে আকর্ষণ করার জন্য এল-আইসোলিউসিন মিথাইল এস্টার (লাইম) এবং এল-লিনালুল নামের ফেরোমোন নির্গত করে। চাইনিজ একাডেমি অফ এগ্রিকালচারাল সায়েন্সের সেলুলার বায়োলজিস্ট ইইনলিয়াং ওয়াং এর মতে পুরুষরা ঘড়ির কাঁটার মতো এই ফেরোমোনের গন্ধে সাড়া দেয়। গবেষকের দল বিটলের সেক্স ফেরোমোন রিসেপ্টর চিহ্নিত করে এবং তাদের উৎপাদিত আণবিক বস্তুর মাধ্যমে তাদের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করে এবং একটি ইলেক্ট্রোঅ্যান্টেনোগ্রামের মাধ্যমে বিটলের অ্যান্টেনার প্রতিক্রিয়া পরিমাপ করে। দেখা গেছে বিটলের রিসেপ্টর এককভাবে লাইম এবং এল-লিনালুল উভয়ের প্রতিই সাড়া দেয়, কিন্তু সবচেয়ে শক্তিশালী সংকেত দেয় যখন উভয় ফেরোমোন একত্রিত হয়। অ্যান্টেনার এই দ্বৈত প্রতিক্রিয়া রাসায়নিক এবং বৈদ্যুতিক উভয় সংকেতে একই দ্বি-রাত্রি বা ২৪-ঘন্টার প্যাটার্ন প্রকাশ করে। এই সার্কাবিডিয়ান রিদম মিলনের সুযোগ যেমন কমিয়ে দেয় তেমনই কমিয়ে দেয় শিকার। পূর্ববর্তী গবেষণা অনুযায়ী যদিও অন্ধকার এই চক্রকে ব্যাহত করে না, তবে আলোর এখনও কিছু ভূমিকা রয়েছে। তাই গবেষকদের মতে এদের অভ্যন্তরীণ কোশ ও স্নায়ুর মধ্যে এমন কোনো প্রক্রিয়া রয়েছে যা ঘড়ি চক্র দ্বিগুণ করতে পারে। হয়ত কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বিটলদের এই ৪৮ ঘণ্টার জীবন ঘড়ি স্থির হয়েছে কিন্তু কেন তাদের দেহ এমন একটি অনন্য সুরে সাড়া দিয়েছে, তা আজও রহস্য রয়ে গেছে।