
পৃথিবীর ইতিহাস এক বিশাল ক্যানভাস। লাভাময়, আগুনঝরা শৈশব থেকে শুরু করে আজকের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, সবটাই এই একটিই গ্রহের গল্প। ছোট্ট এক নীল গ্রহের অবিশ্বাস্য অভিযাত্রা।
শুরু হয়েছিল মহাতারকার – সুপারনোভার – এক বিশাল বিস্ফোরণে। প্রায় ৪.৬ বিলিয়ন বছর আগে, একটি সুপারনোভা বিস্ফোরণের পর মহাকাশে ছড়িয়ে পড়েছিল ধুলিকণা। সেই কণাগুলি জড়ো হয়ে তৈরি হল আমাদের সৌরজগতের জন্মভূমি – সৌর নীহারিকা। কণাগুলি ধীরে ধীরে নিজেদের মধ্যে অভিকর্ষীয় টানে আকৃষ্ট হয়ে ছোট ছোট শিলায় পরিণত হল। পরে সেই শিলাগুলিই একত্র হয়ে তৈরি করল গ্রহাণু। আর তারপর বৃহৎ গ্রহ এবং শেষমেশ আমাদের এই পৃথিবী।
হেডিয়ান যুগ
৪.৬ থেকে ৪ বিলিয়ন বছর আগের সেই আদিম পৃথিবীতে না ছিল কোনো সাগর-মহাসাগর, না ছিল বাতাস-বারি-বায়ুমণ্ডল এমনকি প্রাণের কোনও চিহ্ন। ছিল কেবল আগ্নেয়গিরির উদগিরণ আর মহাজাগতিক উল্কাপিন্ডের বোমাবর্ষণ। গোটা পৃথিবীপৃষ্ঠ ছিল এক লাভা-গোলক। প্রোটোপ্ল্যানেট থেইয়ার সঙ্গে মুখোমুখি এক ধাক্কায় পৃথিবীর একটি অংশ ছিঁড়ে নিয়ে যায় এবং ক্রমে ঠান্ডা হয়ে পরিণত হয় চাঁদে।
আর্কিয়ান যুগ
৪ থেকে ২.৫ বিলিয়ন বছর আগে, পৃথিবী কিছুটা শান্ত হতে শুরু করে। ততদিনে ভূত্বক জমাট বেঁধেছে, আগুনের জায়গায় এসেছে শিলা। এর মাঝেই, পৃথিবীর বুকে আসে প্রথম প্রাণ। সমুদ্রে জন্ম নেয় ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস। আদিম প্রাণ অবিশ্বাস্যভাবে মৌলিক ছিল। মনে রাখতে হবে, তখনও পৃথিবীতে বাতাস নেই। তবে ৩.৫ বিলিয়ন বছর আগে, সাগরের গভীরে, প্রাণ আবিষ্কার করেছিল কিভাবে সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে সূর্য থেকে শক্তি সংগ্রহ করা যায়। সমুদ্রনিবাসী এই জীবাণুগুলি উপজাতক হিসেবে অক্সিজেন ত্যাগ করতে থাকে। সেই অক্সিজেন প্রথমে লোহার সঙ্গে প্রতিক্রিয়া করে। ধীরে ধীরে এই প্রতিক্রিয়ারই ফলস্বরূপ জন্ম নেয় বায়ুমণ্ডল।
প্রোটেরোজোয়িক যুগ
২.৫ বিলিয়ন থেকে ৫৫ কোটি বছর আগের এই সময়কালকে অনেকেই বলেন ‘বোরিং বিলিয়ন’ বা ‘একঘেয়ে শতকোটি ‘। অনেক ঝড় ঝাপটার পরে, আপাতদৃষ্টিতে এই যুগ একেবারে শান্ত এবং নীরব। তবে এরই মাঝে ঘটে যায় ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু অধ্যায়- বায়ুমণ্ডলে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে জমা হতে থাকে প্রাণদায়ী অক্সিজেন। জীবন্ত কোষের ভিতর নিউক্লিয়াসের সূচনা ঘটে। ইউক্যারিওটিক কোষের উদ্ভব এই যুগেই। একঘেয়ে মনে হলেও, এই সময়টাই ভবিষ্যত প্রাণের মঞ্চ তৈরি করে দেয় নীরবে, একটু একটু করে। এই সময়েই পৃথিবীতে প্রথম তুষারগোলকের সৃষ্টি হয়। হিমবাহই বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেন টেনে তোলার অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করতে থাকে। এই হল পৃথিবীর প্রথম তুষারযুগ।
প্লেট টেকটোনিক্স
এই সময়েই পৃথিবী শীতল হয়ে আসতে থাকে এবং পৃথিবীর নানা জায়গায় ভূত্বকের লাভা রূপান্তরিত হয় শিলায়। সাথে সাথে পৃথিবীর অভ্যন্তরভাগ গঠিত হয় প্লেটের মতো বিভিন্ন খণ্ডে। এই টেকটোনিক প্লেটগুলো সংঘর্ষ বাধিয়ে তৈরি করে পাহাড়, মহাসাগরীয় খাদ, আগ্নেয়গিরি। এরাই প্রাণের জন্য প্রয়োজনীয় খনিজ ও পুষ্টি সরবরাহ করে। যা পরবর্তীতে ‘প্রাণের বিস্ফোরণ’ ঘটাতে সাহায্য করে।
ফ্যানেরোজোয়িক যুগ
৫৫০ মিলিয়ন বছর আগে এর শুরু। এই যুগেই আসে ক্যামব্রিয়ান বিস্ফোরণ- পৃথিবীতে প্রথম প্রাণীর আনুষ্ঠানিক আগমন।
ক্ষয়প্রাপ্ত পাহাড় থেকে সমুদ্রে নামতে থাকে পুষ্টি উপাদান- যা প্রাণের বিস্তার ও বৈচিত্র্যের মূল জ্বালানি। এভাবেই শুরু হয় ফ্যানেরোজোয়িক যুগের। এই সময়ে সামুদ্রিক প্রাণীদের চোখ ও পা বিবর্তিত হয়েছে, খোলাওয়ালা মোলাস্কের আবির্ভাব ঘটেছে, শিকারি প্রাণীদের চোয়াল ও দাঁত এবং কৃমিদের ফুলকা বিবর্তিত হয়েছে। হ্যালুসিজেনিয়া এবং জেলিফিশ প্রভৃতি প্রাণীগুলি এমন বিবর্তন সম্পর্কে প্রাথমিক সূত্র দেয়। এরপর, প্রায় ৪৭ কোটি বছর আগে, গাছপালা সমুদ্র ছেড়ে স্থলে উঠে আসে। পরবর্তী ১০ কোটি বছরে, তারা শিকড়, পাতা ও কাণ্ডসহ জটিল রূপ নেয়। মজার কথা, ডাইনোসরদের সময়েও ঘাসের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। এদিকে, গন্ডোয়ানা ও প্যাঞ্জিয়া মহাদেশের গঠন ও বিচ্ছেদ পৃথিবীর জলবায়ু ও ভূপ্রকৃতিতে মস্ত প্রভাব ফেলে। ভূমির আকার, পৃথিবীর মেরু সাপেক্ষে ভূমির অবস্থান এবং সেই ভূমির আগ্নেয়গিরির কার্যকলাপ ,এই সবকিছুই ফ্যানেরোজোয়িক যুগের বিভিন্ন জলবায়ুতে অবদান রেখেছিল।
ডাইনোসর – মেসোজোয়িক যুগ
মাটির নীচে জীবাশ্ময় প রি ণ ত বিশাল দাঁত, থাবা, ধারালো নখ পৃথিবীর হারিয়ে যাওয়া শাসকের সাক্ষাৎ প্রমাণ। ডাইনোসর হল ভূতাত্ত্বিক ইতিহাসের এক গর্জনমুখর অধ্যায়- মেসোজোয়িক যুগ। প্রায় ২৫০ মিলিয়ন বছর আগে, উন্নত হাড়ের গঠন, অভিযোজনশীল খাদ্যাভ্যাস, আর এক অদম্য অভিযাত্রা-ক্ষমতাসম্পন্ন ডাইনোসর ছিল রাজা, আর প্রকৃতি ছিল তাদের রাজ্য। তাদের স্বর্ণযুগ চলেছিল ট্রায়াসিক, জুরাসিক এবং ক্রিটেশিয়াস- এই তিন গুরুত্বপূর্ণ ভূতাত্ত্বিক যুগে। এই তিন উপসময়ই একত্রে গড়ে তোলে মেসোজোয়িক যুগকে। ট্রায়াসিকে তারা হাঁটতে শিখল, জুরাসিকে দৌড়াতে, আর ক্রিটেশিয়াসে রীতিমতো শিকার করতে। এল বিশাল স্যারোপড, হিংস্র থেরোপড আর উড়ন্ত টেরোসর।
গণবিলুপ্তির যুগ – মৃত্যু আর নবজন্মের চক্র
প্রাণের ইতিহাস শুধু সৃষ্টির কথা বলে না, গল্প বলে ধ্বংসেরও। পৃথিবীতে এখনও অবধি ঘটেছে অন্তত ছয়টি গণবিলুপ্তি- পৃথিবী দাপানো ডাইনোসরদের মৃত্যু ঘটে বিশাল এক গ্রহাণুর বিস্ফোরণের আঘাতে – ৬৬ মিলিয়ন বছর আগে। এই বিলুপ্তিগুলি প্রাণের বিবর্তনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কারণ এর ফলে এই গ্রহে প্রজাতির সংখ্যা হ্রাস পায়।পরবর্তী লক্ষ লক্ষ বছরে, বিলুপ্তির মধ্য দিয়ে আসা প্রাণীদের থেকে নতুন নতুন জীবের উদ্ভব ঘটে, যা অবশেষে আজকের প্রাণ জগতের দিকে পরিচালিত করে।
মানুষের আবির্ভাব- অ্যানথ্রোপোসিন যুগ
নীল গ্রহের বুকে আমাদের উদ্ভব নিতান্ত সাম্প্রতিক ঘটনা। যদি পৃথিবীর ৪.৫৬ বিলিয়ন বছরের ইতিহাসকে ২৪ ঘণ্টার ঘড়ির ছকে ফেলা যায়, তাহলে আমরা অর্থাৎ হোমো সেপিয়েন্স এসেছি শেষ কয়েক সেকেন্ডে ( ৩ লাখ বছর আগে)। আর শিল্পবিপ্লব? সে তো নিছক শেষ মুহূর্তের হঠাৎ আলোড়ন। বিজ্ঞানীরা একে অ্যানথ্রোপোসিন যুগ বলে অভিহিত করছেন। মানব-প্রভাবিত নতুন ভূতাত্ত্বিক যুগের চিহ্ন ফুটে উঠছে প্রতিটি স্তরে।
কিন্তু বর্তমানে আমরা যেন উদ্ভাবনশীল তার নামে বিলুপ্তির দিকেই হাঁটছি। হিমবাহ গলছে, সমুদ্রের অম্লমাত্রা বদলাচ্ছে, জীববৈচিত্র্য হারিয়ে যাচ্ছে এমন গতিতে, যা গত পাঁচটি বৃহৎ বিলুপ্তির সঙ্গেও পাল্লা দিতে পারে।
পৃথিবীর ইতিহাস মানে শুধু পাথর বা ডাইনোসরের কঙ্কাল নয় – এ এক আশ্চর্য কাহিনি। যেখানে বিস্ফোরণ থেকে প্রাণ, ধ্বংস থেকে সৃষ্টি, আর গলা চিপে ধরা মানবসভ্যতা- সব একসাথে গাঁথা আছে। আমরা এই ইতিহাসের শেষের পাতায় থাকা দু চারটে অক্ষর মাত্র। আর সেই অক্ষরগুলো যদি ঠিকভাবে না জেনেই পাতাটা ছিঁড়ে ফেলি, তাহলে ভবিষ্যতের কোনো পাঠকই আর এই গল্পটা পড়তে পারবে না। পৃথিবীর এই বিচিত্র যাত্রাপথ এখনও শেষ হয়নি। জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ প্রতিনিয়ত করে চলেছে আমাদের মতো অন্য পৃথিবীর সন্ধান।
লেখাটা খুব মনোগ্রাহী হয়েছে 👍🏼