পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনে স্মরণীয় এক মহিলা

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনে স্মরণীয় এক মহিলা

সুদীপ পাকড়াশি
Posted on ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

পাটি নামেই জনপ্রিয়তা তার। পুরো নাম মার্থা ইজাবেল রুইজ কোর্জো। মেক্সিকোর উত্তরে, মেক্সিকো শহর থেকে দু’ঘন্টার দূরত্বে কোয়েরেতারো শহর ছিল তার বাসথান। শহরের একমাত্র মহিলা ভায়োলিন বাদক। শহরে থাকা একটাই অর্কেষ্ট্রা দলের অন্যতম ভায়োলিন বাদক। তার সঙ্গে একটি মিউজিম স্কুলের শিক্ষিকা। আটের দশকের গোড়ার কথা। একদিন পাটির মনে হল, শহর ছেড়ে দেবেন। গ্রামে থাকবেন। জীবনযাপন আরও সরল এবং সহজ হবে। গোটা পরিবারকে নিয়ে চলে গেলেন সিয়েরা গোর্দায়। শহরে থাকার সমস্ত রকমের স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়ে। সেটাই হয়েছিল। সিয়েরা গোর্দায় বিদ্যুৎ ছিল না। ওই অবস্থায় পাঁচ বছর তার কাটিয়ে দেওয়া। মার্থা চেয়েছিলেন প্রকৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তৈরি করতে।
কিন্তু ঘনিষ্ঠতা করতে গিয়েই যত বিপত্তি। চোখের সামনে দিনের পর দিন মার্থাকে দেখতে হছিল পরিবেশ ধ্বংসের লীলাখেলা। যথেচ্ছভাবে গাছ কাটা, অনিয়ন্ত্রিত ও ইচ্ছেমত জঙ্গলে আগুন লাগিয়ে দেওয়া, প্রাণী হত্যা করে তাদের শরীরের বিভন্ন অংশ চোরাকারবারি হওয়া এবং অরণ্যে অবৈধভাবে বহিরাগতের প্রবেশের জন্য নির্বিচারে জঙ্গল কেটে রাস্তা তৈরি করার চেষ্টা। চোখ বুঁজে থাকতে পারেননি মার্থা। অরণ্যে বহু যুগ ধরে থাকা আদিবাসী ও উপজাতিদের সঙ্গে একের পর এক আলোচনায় বসলেন তিনি। তার জন্য কম হুমকি পেতে হয়নি মার্থাকে। তার পরিবারের সদস্যদের অপহরণ পর্যন্ত করার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু অদম্য মার্থা। তাকে দমানো যায়নি। ১৩০টা মিটিং মার্থা করেছিলেন উপজাতি ও আদিবাসীদের সঙ্গে। সরকারকে পিটিশন দেওয়ার আগে। তার প্রতিফলন? সিয়েরা গোর্দাকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল (বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ) বলে ঘোষণা করেছিল সরকার।
প্রাথমিকভাবে তীব্র বাধার সঙ্গে লড়াই করার পর ১৯৯৭-এ মার্থা সাফল্যের মুখ দেখতে শুরু করেন। ততদিনে ধ্বংসপ্রাপ্ত জঙ্গলকে পুনরুদ্ধার করার লড়াইয়ে স্থানীয় উপজাতিদের সঙ্গে নিয়ে মার্থা গাছ লাগানোর কাজ করছেন, কৃত্রিম জলাভূমি তৈরি করছেন, জঙ্গলে ফিরে আসা প্রাণীদের লালন পালনের ব্যবস্থা করছেন। স্থানীয় মাউন্টেন আদিবাসীদের নিয়েই তৈরি করেছেন সিয়েরা গোর্দা ইকোলজিক্যাল গ্রুপ। বাধ্যতামূলকভাবে যে দলের কাজ জঙ্গলের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করা এবং বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে আর্থিক অনুদান সংগ্রহ করা। তারপর থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি ভায়োলিন বাদক মার্থাকে। সরকার সিয়েরা গোর্দার যে অরণ্যকে মেক্সিকোর সরকার সংরক্ষিত বনাঞ্চল বলে ঘোষণা করেছে মার্থাদের চাপে, তার পরিমাণ ৩ লক্ষ ৮৫ হাজার হেক্টর। সিয়েরা গোর্দার এক-তৃতীয়াংশ সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণা হওয়ার পর মার্থাদের ইকোলজিক্যাল গ্রুপ আরও বেশি জায়গা জুড়ে কাজ চালিয়ে যায়। কোয়েরেতারো শহরের বাইরেও চলতে থাকে তাদের কাজ।
আজ মার্থার সঙ্গে সিয়েরা গোর্দার পুনরুজ্জ্বীবনে কাজ করছেন ১৭ হাজার মানুষ। ঝুলিতে এসেছে একাধিক আন্তর্জাতিক পুরষ্কার। সম্মিলিত রাষ্ট্রপুঞ্জের পুরষ্কার, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের পুরষ্কার সহ একাধিক প্রাপ্তি। মার্থা জানিয়েছেন এর চেয়েও তার বড় প্রাপ্তি, সংরক্ষিত বনাঞ্চলের বাইরেও ব্যক্তিগত মালিকানায় থাকা প্রচুর জমি তার গ্রুপকে স্বেচ্ছায় দান করেছেন প্রচুর জমির মালিক। শুধু কী অরণ্য সংরক্ষণ? স্থানীয় আদিবাসীদের সন্তাদের জন্য মার্থা তৈরি করেছেন ১৭০টি স্কুল। বাচ্চাদের পড়াশুনোর জন্য স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যেই নিয়োগ করেছেন শিক্ষক। পেয়েছেন গ্লোবাল সিটিজেন পুরষ্কার।
৭০ বছর বয়সী মার্থা মেক্সিকোয় আজ চিরস্মরণীয় এক নাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

3 × two =