পল জোহানেস ব্রুল (১৮৫৫–১৯৩৫) ছিলেন জার্মান বংশোদ্ভূত এক অসাধারণ বহুমুখী প্রতিভা। জার্মান বংশোদ্ভূত হলেও তাঁর কর্মজীবনের শ্রেষ্ঠ অধ্যায় রচিত হয় ভারতে। তিনি তাঁর জীবন উৎসর্গ করেন ভারতীয় উচ্চশিক্ষা ও উদ্ভিদবিজ্ঞানের অগ্রগতিতে। উদ্ভিদবিদ, ভূতত্ত্ববিদ, শিক্ষক, গবেষক—এই সব পরিচয়ের বাইরেও তিনি ছিলেন একজন গভীর মানবিক ও ছাত্র-দরদী ব্যক্তিত্ব, যার বিজ্ঞানের প্রতি গভীর অনুরাগ বহু প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে গেছে।
১৮৫৫ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তিনি জন্মগ্রহণ করেন জার্মানির স্যাক্সনি অঞ্চলের ছোট্ট গ্রাম ওয়াইফাতে। পিতার নাম মাইকেল ব্রুল। শৈশব থেকেই প্রকৃতিকে জানতে আর নতুন নতুন উদ্ভিদ খুঁজে বের করতে তিনি প্রবল আকর্ষণ বোধ করতেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তিনি ইউরোপ জুড়ে উদ্ভিদ সংগ্রহের জন্য এক বিশেষ বৃত্তি পান। এই বৃত্তির সুবাদে এক দুঃসাহসিক অভিযানের রং লাগে তাঁর জীবনে। তিনি পদব্রজে ইউরোপ পাড়ি দিয়ে সেখান থেকে উদ্ভিদ সংগ্রহ করতে করতে এশিয়া মাইনর পর্যন্ত পৌঁছান। তারপর কনস্টান্টিনোপলে কিছুদিন শিক্ষকতা করে ১৮৮১ সালে ভারতে আসেন। এই ভারতই পরবর্তীতে তাঁর কর্মজীবনের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়।
তখনকার অবিভক্ত ভারতে তাঁর প্রথম গন্তব্য ছিল পূর্ব বাংলার রাজশাহী কলেজ। সেখানে ১৮৮২ সালে বিজ্ঞান শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েই তিনি ছাত্রদের মনের মণিকোঠায় প্রিয় শিক্ষক হিসেবে জায়গা করে নেন। বছর ঘুরতেই ১৮৮৩ সালে তিনি অ্যানি বেটস ফক্সকে বিয়ে করেন। তাঁর জীবনের প্রকৃত বৈজ্ঞানিক যাত্রা শুরু হয় এবং ভারতের বৈজ্ঞানিক মহলের সঙ্গে তাঁর পরিচিতি বিকশিত হয় যখন বিখ্যাত উদ্ভিদবিদ স্যার জর্জ কিং তাঁর মেধা উপলব্ধি করে তাঁর প্রতি আগ্রহ দেখান। স্যার জর্জ কিং -এর সুপারিশে ১৮৮৭ সালে ব্রুল যোগ দেন বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমান IIEST শিবপুর)। সেখানে তিনি রসায়ন, ভূতত্ত্ব এবং কৃষিবিজ্ঞান পড়িয়ে খুব অল্প সময়েই নিজেকে দক্ষ এবং সর্ব বিদ্যায় পারদর্শী শিক্ষক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন।
ব্রুলের বৈজ্ঞানিক অবদানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ১৮৯৬ সালে স্যার জর্জ কিং-এর সঙ্গে যৌথভাবে প্রকাশিত গ্রন্থ ‘দ্য সেঞ্চুরি অফ নিউ অ্যান্ড রেয়ার ইন্ডিয়ান প্ল্যান্টস’ । এই বহুপ্রশংসিত গ্রন্থে ভারতের বিরল ও নতুন আবিষ্কৃত উদ্ভিদসমূহের বৈজ্ঞানিক বিবরণ সংকলিত হয়, যা পরবর্তী উদ্ভিদ গবেষণার ভিত্তি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ছাত্রদের প্রতি তাঁর সহৃদয় আচরণ এবং শিক্ষাদানে তাঁর গভীর নিষ্ঠা তাঁকে ছাত্রমহলে অত্যন্ত জনপ্রিয় করে তোলে। যেকোনো কঠিন বিষয়কেও তিনি এমন সহজ করে বোঝাতেন যে, তাঁর ক্লাস সবসময় ছাত্রে ভর্তি থাকত। বিজ্ঞান শেখানোর পাশাপাশি তিনি ছাত্রদের মধ্যে কৌতূহল, চিন্তাশক্তি ও গবেষণার প্রতি আগ্রহ জাগিয়ে তুলতেন, যা তাঁকে আরও অনন্য করে তুলেছিল।
১৯০২–০৩ সালে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে ভূতত্ত্বের অস্থায়ী প্রভাষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। দীর্ঘ প্রায় ২৫ বছর বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে কাজ করার পর ১৯১২ সালে তিনি অবসর নেন। এবং তাঁর দীর্ঘ সেবার স্বীকৃতিস্বরূপ ইম্পেরিয়াল সার্ভিস অর্ডার সম্মানে ভূষিত হন।
অবসর মানেই তো আর থেমে যাওয়া নয়। তাই অবসরের পরও বিজ্ঞানের প্রতি তাঁর অনুরাগ বিন্দুমাত্র কমেনি। ১৯১২–১৩ সালে বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স-এ ভূ-রসায়ন নিয়ে তিনি গবেষণা করেন । এরপর ১৯১৩ সালে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের অনুরোধে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব নেন। যদিও প্রশাসনিক কাজ তাঁর কাছে তেমন আনন্দদায়ক ছিল না, তবুও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে সে দায়িত্বও পালন করেন। ১৯১৪ সালে তিনি ইংল্যান্ডে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন, কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যায় ।
পরবর্তীতে ১৯১৮ সালে তিনি শিক্ষক হিসেবে নতুনভাবে যাত্রা শুরু করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যার অধ্যাপক হিসেবে। ১৯২৮ সাল পর্যন্ত এই পদে থেকে তিনি শিক্ষাক্ষেত্রে ও গবেষণায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। তাঁর গবেষণার ক্ষেত্র ছিল বৈচিত্র্যময়—ক্রিপ্টোগ্যাম/অপুষ্পক উদ্ভিদ, শৈবাল, মস, অর্কিড, আগ্রাসী উদ্ভিদ এবং বিশেষ করে জলজ আগাছা কচুরিপানা নিয়ন্ত্রণের উপায় খোঁজা। বাংলার জলাশয়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়া এই আগাছা দমনে তাঁর গবেষণা মোক্ষম পথ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
ব্রুলের ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারও ছিল অন্যতম অমূল্য রত্নের খনি। সেখানে ম্যাক্সওয়েল, বোল্ট্জমান, প্ল্যাঙ্কের মতো প্রখ্যাত বিজ্ঞানীদের সমসাময়িক পদার্থবিদ্যা বিষয়ক জার্মান গ্রন্থ সংরক্ষিত ছিল। এই গ্রন্থাগার কলকাতার তরুণ কিংবদন্তি বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু এবং মেঘনাদ সাহাদের মতো গবেষকদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছিল। ব্রুলের এই মহৎ উদ্যোগ ভারতে নতুন পদার্থবিজ্ঞান চর্চায় নবযুগ আনে ।
১৯৩৫ সালের ৭ সেপ্টেম্বর তাঁর মৃত্যু হলেও ভারতের শিক্ষাক্ষেত্রে ও উদ্ভিদবিজ্ঞানে তাঁর অবদান আজও অম্লান। জার্মান নাগরিক হয়েও তিনি ভারতকে করেছেন তাঁর কর্মভূমি। আর ভারত তাঁকে স্মরণ করে একজন মানবিক, সত্যনিষ্ঠ এবং ছাত্র বৎসল মেধাবী শিক্ষক হিসেবে। যাঁর জীবন প্রমাণ করে যে জ্ঞানচর্চা কখনও সীমান্ত মানে না; এটি এক শাশ্বত আলোর ধারা। জ্ঞানের প্রতি এই অকৃত্রিম ,অগাধ ভালোবাসা তাঁকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে চিরস্মরণীয় করে রেখেছে আজও ।
সূত্র: Wikipedia and others
