পাইন সূচে স্বর্ণরেণু 

পাইন সূচে স্বর্ণরেণু 

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ৯ ডিসেম্বর, ২০২৫

সম্প্রতি উত্তর ফিনল্যান্ডের গভীর বোরিয়াল অরণ্যে গবেষকেরা এমন এক আবিষ্কারের মুখোমুখি হয়েছেন, যা শুনলে অবাকই হতে হয়। তাঁরা বলছেন উদ্ভিদের কাজ শুধু সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ায় সকল প্রাণের অপরিহার্য খাদ্য তৈরি করা নয়। কিছু উদ্ভিদ সোনাও তৈরি করে। ক্রিসমাস ট্রি হিসেবে পরিচিত নরওয়ের পাইন গাছের সূঁচালো অঙ্গের ভেতরেই জন্ম নিচ্ছে বাস্তব স্বর্ণ। শুধু তাই নয়, এই স্বর্ণ গড়ে তোলায় মূল কারিগর হচ্ছে গাছের ভেতর বসবাসকারী অণুজীব।

ওউলু বিশ্ববিদ্যালয় ও ফিনল্যান্ডের ভূতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগের বিজ্ঞানীরা কিত্তিলা স্বর্ণখনির উপরবর্তী এলাকায় বেড়ে ওঠা ২৩টি পাইন গাছ থেকে ১৩৮টি সূঁচ সংগ্রহ করেন। এর এক অংশে উচ্চক্ষমতার ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ ও এক্স-রে স্পেকট্রোস্কোপি ব্যবহার করে খুঁজে দেখা হয় স্বর্ণের ন্যানোকণা। অন্য অংশে ১৬এস rRNA জিন সিকোয়েন্স করে শনাক্ত করা হয় সূঁচের ভেতরে থাকা ব্যাকটেরিয়া।

ফলাফলে দেখা যায়, চারটি গাছের সূঁচে স্বর্ণের ন্যানোকণা রয়েছে এবং আশ্চর্যের বিষয়, স্বর্ণকণাগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লেগে আছে ব্যাকটেরিয়ার তৈরি বায়োফিল্মের পাশে। মাইক্রোস্কোপিক ছবিতে বারবার দেখা গেল: উজ্জ্বল, ঘন স্বর্ণের বিন্দুর কাছে গুটিসুটি মেরে থাকা ব্যাকটেরিয়ার দল। যখন ওই ব্যাকটেরিয়াদের পরিচয় খোঁজা হলো, তখন সামনে এল কয়েকটি স্বাক্ষরিত নাম—P3OB-42, কিউটিব্যাক্টেরিয়াম এবং কোরিনেব্যাক্টেরিয়াম —যারা স্বর্ণযুক্ত সূঁচে অন্যদের তুলনায় বেশি উপস্থিত। এ থেকে ধারণা করা হচ্ছে, এই অণুজীবরা দ্রবণীয় স্বর্ণ আয়নকে কম দ্রবণীয় করে কণায় রূপান্তরিত করতে ভূমিকা রাখে।

এখানেই গবেষণার মোড় ঘোরে। স্বর্ণ সাধারণত মাটির নীচে দ্রবণীয় আয়নের রূপে থাকে। জল যখন সেই স্বর্ণ-আয়ন বহন করে গাছের দেহে তুলে আনে, তখন সূঁচের মধ্যে মাইক্রোবদের তৈরি ক্ষুদ্র পরিবেশ—বায়োফিল্ম—সেখানে রসায়নের নিয়ম বদলে দেয়। দ্রবণীয় আয়ন ধীরে ধীরে জমে কঠিন ন্যানোকণায় রূপ নেয়। গাছ ধাতু জমাতে চায় বিষাক্ততা এড়াতে, আর ব্যাকটেরিয়াগুলোর জন্য বায়োফিল্ম হল নিরাপদ আশ্রয়—অতএব উভয়েরই লাভ।

অবশ্য সব গাছে স্বর্ণের উপস্থিতি দেখা যায়নি। সেটাই স্বাভাবিক—কারণ গাছভেদে জল গ্রহণের পথ ও মাইক্রোবায়োম আলাদা হতে পারে। তবুও যেসব সূঁচে স্বর্ণ ছিল, সেখানে ব্যাকটেরিয়ার বৈচিত্র্য তুলনামূলকভাবে কম দেখা গেছে, যা নির্দিষ্ট ব্যাকটেরিয়ার সম্ভাব্য ভূমিকাকে আরও স্পষ্ট করে।

এই গবেষণা শুধু বৈজ্ঞানিক কৌতূহল নয়, বাস্তব সুবিধার দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। উদ্ভিদ-ভিত্তিক খনি অনুসন্ধানে যদি নির্দিষ্ট মাইক্রোব স্বর্ণের ইঙ্গিত দিতে পারে, তাহলে পরিবেশের ক্ষতি না করেই খনিজ অনুসন্ধান আরও নিখুঁতভাবে করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি একই প্রক্রিয়া ব্যবহার করে শৈবাল বা জলজ উদ্ভিদের মাধ্যমে দূষিত জল থেকে ধাতু অপসারণের নতুন পথও খুলে যেতে পারে। স্বর্ণকণা-জমানো এই মাইক্রোবিক রসায়ন উদ্ভিদ, মাটি ও খনিজসমৃদ্ধ ভূবিজ্ঞান—তিনটির মধ্যকার গভীর সম্পর্ককে নতুন দৃষ্টিতে তুলে ধরে। ভবিষ্যতের গবেষণা ধাপে ধাপে প্রমাণ করবে—প্রকৃতির এই ক্ষুদ্র অংশিদাররা কীভাবে অদৃশ্যভাবে পৃথিবীর খনিজচক্রকে নিয়ন্ত্রণ করে।

 

সূত্র : Biomineralized gold nanoparticles along with endophytic bacterial taxa in needles of Norway spruce (Picea abies) by Kaisa Lehosmaa, Piippa R. Wäli, et.al; published in the journal Environmental Microbiome, 3rd December, 2025.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

2 − 2 =