পাখি বিনাশ ও পাখি পুনরুদ্ধার

পাখি বিনাশ ও পাখি পুনরুদ্ধার

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ৪ মে, ২০২৫

উত্তর আমেরিকার পাখিরা হারিয়ে যাচ্ছে। যেখানেই তারা ভিড় জমাতে চেষ্টা করছে, সেখান থেকেই যেন দ্রুততম হারে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে ! স্থানীয় বিজ্ঞানীদের সংগৃহীত প্রায় দুই দশকের তথ্য ব্যবহার করে নতুন এক গবেষণা বলছে, যে যে অঞ্চলগুলিতে পাখিদের বেড়ে ওঠা উচিত ছিল, সেখানেই তাদের সংখ্যা উল্টে হ্রাস পাচ্ছে। এ যেন এক ‘পরিবেশগত জরুরি অবস্থা’। কিন্তু সেই সঙ্গে তাদের পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনাও খুলে যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে। কর্নেল ল্যাব অব অর্নিথোলজির গবেষকদের দ্বারা পরিচালিত এই বিশ্লেষণে, ৩ কোটি ৬০ লক্ষেরও বেশি পাখির পর্যবেক্ষণ-তথ্য ব্যবহার করা হয়। এখানে, ২০০৭ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ৪৯৫টি প্রজাতির পাখির কথা নথিভুক্ত হয়েছিল। গবেষকরা উত্তর আমেরিকা জুড়ে পাখির জনসংখ্যার একটি বিশদ চিত্র তৈরি করার চেষ্টা করছেন। ফলাফলটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। প্রায় ৮৩% প্রজাতির মধ্যে, যেখানে পাখির সংখ্যা সবচেয়ে বেশি থাকার কথা ছিল সেখানেই জনসংখ্যা হ্রাস সবচেয়ে তীব্র। গবেষক অ্যালিসন জনস্টন বলেন, “আমরা কেবল ছোটখাটো পরিবর্তন ঘটতে দেখছি না, জনসংখ্যার হ্রাসের তথ্য নথিভুক্ত করছি। একসময় যেখানে তাদের প্রচুর সংখ্যায় দেখা মিলত, যে সকল জায়গা একসময় নির্দিষ্ট প্রজাতির জন্য আদর্শ আবাসস্থল এবং জলবায়ু-পরিসর হিসাবে জানা যেত, সেগুলিই এখন আর উপযুক্ত নয়। আমার মনে হয়, আমাদের চারপাশের প্রকৃতি যে আরও বড় পরিবর্তনের দিকে যাচ্ছে, এ তারই ইঙ্গিত”। পূর্ববর্তী গবেষণাগুলি সামগ্রিক ক্ষতির বিষয়ে সতর্ক করেছিল। ১৯৭০ সাল থেকেই উত্তর আমেরিকা তার প্রজননকারী পাখিদের ২৫% এরও বেশি প্রজাতিকে হারিয়েছে। কিন্তু কার্যকরভাবে প্রতিক্রিয়া জানার জন্য নিদিষ্ট কোন জায়গাতে তাদের এই সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে, তা জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এখনও পর্যন্ত, পাখিদের এই ‘স্থানীয় পতন’ চিহ্নিত করার প্রচেষ্টা একটি বড় বাধার সম্মুখীন হচ্ছিল প্রজাতি পরিসরে সূক্ষ্ম এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ তথ্যের অভাবে। জনস্টনের দল বিপূল বৈচিত্র্যময় তথ্যের যোগান দিয়ে একটি মেশিন লার্নিং মডেল ব্যবহার করে, এটিকে মোকাবেলা করার চেষ্টা করেন। মানুষের পর্যবেক্ষণ -নির্ভর তথ্য প্রায়শই এই কাঁচা গণনাকে বিকৃত করতে পারে ! অপরদিকে মডেলটি পাখিদের প্রকৃত জনসংখ্যার পরিবর্তনগুলিকে পর্যবেক্ষক ঘটিত পার্থক্য থেকে পৃথক করেছে। ফলত, আঞ্চলিক প্রবণতাগুলির একটি পরিষ্কার চিত্র ফুটে উঠেছে। কেবল উত্তর আমেরিকা জুড়েই নয়, মধ্য আমেরিকা এবং ক্যারিবিয়ান অঞ্চলেও পাখির সংখ্যার পরিবর্তনের একটি উচ্চমানের মানচিত্র পাওয়া যায়। বৃহৎ চিত্রটি দেখাচ্ছে, ৭৫% পাখির প্রজাতি হ্রাস পাচ্ছে, যার মধ্যে ৬৫% উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাচ্ছে। তবে স্থানীয় দৃষ্টিভঙ্গি আরও জটিল ! প্রায় প্রতিটি প্রজাতির (৯৭%) লাভ ক্ষতি উভয় দিকই বিচার করা হয়। আশার কথা, এটি ইঙ্গিত দিচ্ছে যে কিছু অঞ্চল আশ্রয় দেওয়ার জন্য উপযুক্ত আবার কিছু অঞ্চল জলবায়ু পরিবর্তন এবং আবাসস্থল কমে যাবার কারণে চাপের মুখে রয়েছে। “এই প্রথম আমরা এত বিস্তৃত স্থানিক পরিধি এবং প্রজাতির সমগ্র পরিসরে জনসংখ্যার পরিবর্তন সম্পর্কে এমন সূক্ষ্ম তথ্য পেয়েছি। পাখির জনসংখ্যার পাশাপাশি একই সাথে ঘটতে থাকা পরিবর্তনগুলিকেও বোঝার ক্ষেত্রে এটি আরও ভাল দৃষ্টিকোণ তৈরি করতে সাহায্য করে”। সহ- গবেষক আমান্ডা রোডওয়াল্ড বলেন, এমনকি আঞ্চলিক স্তরে ‘স্থিতিশীল’ হিসাবে বিবেচিত পাখিদেরও আজ তাদের মূল অঞ্চলে লড়াই করতে হচ্ছে, আবার কম ঘনত্বের অঞ্চলের প্রজাতিগুলি কখনও কখনও ভালো থাকছে। এই নিদর্শনগুলিই প্রমাণ, প্রান্তিক অঞ্চলগুলি নিরাপদ হতে পারে। তৃণভূমি এবং শুষ্ক ভূমিতে, প্রজননকারী পাখিদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি হ্রাস পায়। আসলে, এই বাস্তুতন্ত্রগুলি আবাসস্থলের ঘাটতি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতি বিশেষ সংবেদনশীল। অনুসন্ধানগুলি এই ইঙ্গিত দেয় যে আজ যা ‘প্রাচুর্য’ বলে মনে হয়, তার আদপে নিজস্ব স্থিতিস্থাপকতার ‘স্থায়িত্ব’ নেই। প্রকৃতপক্ষে, কোনো অঞ্চল প্রাচুর্যে পরিপুর্ণ হলেও, সেখানে ব্যাপক সংখ্যায় পাখিরা ভিড় জমাতে থাকলে সম্পদের গুণগত মান দ্রুত হ্রাস পাবে। তবে সব অঞ্চলেই যে ক্ষয়ক্ষতি দেখা যায়, তা নয়। অ্যাপালাচিয়ান এবং পশ্চিম পর্বতমালায় স্থিতিশীল বা ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই অঞ্চলগুলি অন্য জায়গার পাখিদের পুনরুদ্ধার প্রচেষ্টার জন্য সম্ভাব্য বিকল্প হতে পারে।

“যেসব জায়গায় প্রজাতিগুলি, সংখ্যায় বৃদ্ধি পাচ্ছে অথচ স্থানীয় প্রাচুর্য কম, সেখানে সংরক্ষণ সফল হয়েছে এবং জনসংখ্যা পুনরুদ্ধার হচ্ছে, অথবা তারা এমন জায়গাগুলির দিকে যাচ্ছে, যেখানে এই প্রজাতিগুলির পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা থাকতে পারে। কার্যকারণ মেশিন লার্নিং মডেল এবং অভিনব পরিসংখ্যানগত পদ্ধতি ব্যবহার করে উচ্চ মানের স্থানীয় ছবির সাথে পাখি জনসংখ্যার পরিবর্তনগুলি অনুমান করার চেষ্টা করছি। একই সাথে মানুষ কীভাবে এবং কোথায় পাখিদের ক্ষতি ডেকে আনছে, তার পরিবর্তন থেকে আসা পক্ষপাতগুলির হিসাবও করছি,” ড্যানিয়েল ফিঙ্ক বলেন। গবেষণাটি ৫ লক্ষেরও বেশি সিমুলেশন চালায়। এর জন্য ৬০ লক্ষ ঘন্টারও বেশি কম্পিউটিং ক্ষমতার প্রয়োজন ছিল। যা একটি সাধারণ ল্যাপটপে প্রায় ৮৫ বছর কাজ করার সমান ! এই প্রযুক্তিগত প্রচেষ্টা, স্থানীয় বিজ্ঞানের প্রতি জনসাধারণের প্রতিশ্রুতির সাথে মিলে মিশে একাকার হয়েছে। ‘ই-বার্ড’ এর মতো কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারী স্বেচ্ছাসেবকদের উৎসাহ, এবং সময়ের ব্যাপ্তির কারণে, আমরা এখন পাখির সংখ্যা এবং পরিবেশ সম্পর্কে আগের চেয়ে অনেক বেশি জানি,” রোডওয়াল্ড বলেন। গবেষণার মানচিত্র এবং উন্নত প্রযুক্তি, নীতিনির্ধারকদের আরও ধারালো সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে। “বিস্তৃত ভৌগোলিক অঞ্চল জুড়ে এই ধরণের সূক্ষ্ম স্তরের তথ্যের অভাব রয়েছে। এটি বুদ্ধিপূর্বক সংরক্ষণ-সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য প্রয়োজন,” রোডওয়াল্ড বলেন। পাখিদের সংখ্যা ঠিক কোথায় কমে যাচ্ছে বা ভালো হচ্ছে তা দেখে, সংরক্ষণগোষ্ঠীগুলি আরও নির্ভুলতার সাথে কাজ করতে পারবে। এই অন্তর্দৃষ্টি তাদের পাখি সংখ্যা পুনরুদ্ধারের দিকে মনোনিবেশ করার সুযোগ বাড়িয়ে দেবে। বার্তা স্পষ্ট – উত্তর আমেরিকার পাখিরা তাদের সবচেয়ে নিরাপদ স্থানেও সংকটে আছে। তবে বিস্তারিত অন্তর্দৃষ্টি এবং সক্রিয় তত্ত্বাবধানে, ‘পুনরুদ্ধার’ও নাগালের মধ্যেই রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

10 − three =