পারকিনসন রোগ ও ‘অণু-ড্রিল’

পারকিনসন রোগ ও ‘অণু-ড্রিল’

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১৯ অক্টোবর, ২০২৫

পারকিনসন রোগের অন্ধকার রহস্য একটু আলোকিত হলো। এই প্রথম বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, রোগটির মূল অভিযুক্ত প্রোটিন আলফা-সাইনিউক্লিন,মস্তিষ্ক কোষের ঝিলিকায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গর্ত তৈরি করছে। এক প্রকার ‘অণু-ড্রিল’ যেন নিঃশব্দে কোষের শক্ত প্রাচীরে ছিদ্র করছে। ডেনমার্কের অরহাস বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক দল উন্নত মাইক্রোস্কোপি ও ‘একক-ভেসিকল বিশ্লেষণ’ প্রযুক্তির মাধ্যমে এই প্রক্রিয়া সরাসরি ক্যামেরাবন্দি করেছেন। স্বাস্থ্যবান মস্তিষ্কে আলফা-সাইনিউক্লিন প্রোটিন স্নায়ুকোষগুলোর মধ্যে সংকেত পরিবহনে সহায়ক। কিন্তু পারকিনসনের অসুখে এটির আচরণ পাল্টে যায়। এরা একত্রিত হয়ে ছোট ছোট দল বা অলিগোমার তৈরি করে যা শেষ পর্যন্ত কোষঝিলিকা ভেদ করে ফেলে। গবেষক মাইকেল লিন্ডবার্গ বলেছেন, “আমরা আসলে দেখেছি কীভাবে এই প্রোটিন ধীরে ধীরে কোষঝিলিকাকে গিলে ফেলছে। যেন মাইক্রো-স্কেলে একটি ক্ষুদ্র খননযন্ত্র কাজ করছে।” তাঁরা গবেষণাগারে তৈরি কৃত্রিম ভেসিকল ব্যবহার করেছেন, যা জীবন্ত কোষ ঝিলিকারই অনুকরণ। সেখানে দেখা যায়, আলফা-সাইনিউক্লিন অলিগোমার প্রথমে ঝিলিকায় আটকে যায়, তারপর ধীরে ধীরে ভেতরে প্রবেশ করে। শেষ পর্যন্ত গঠন করে একটি অণু-ছিদ্র, যার মাধ্যমে ভেতরের অণুগুলি বাইরে বেরিয়ে আসে। অদ্ভুত ব্যাপার, এই গর্তগুলি কিন্তু স্থায়ী নয়। তারা খোলা-বন্ধ হতে থাকে, যেন ক্ষণস্থায়ী ঘুরন্ত দরজা। গবেষকদের মতে, এটাই হয়তো ব্যাখ্যা করে কেন পারকিনসনের কোষগুলো একবারেই ধ্বংস না হয়ে ধীরে ধীরে মারা যায়। এটি এক বিরল মুহূর্ত, যখন বিজ্ঞানীরা মস্তিষ্ক-ক্ষয়ের প্রক্রিয়া সরাসরি ‘চলচ্চিত্র’ আকারে দেখতে পেয়েছেন। নতুন ইমেজিং পদ্ধতির মাধ্যমে প্রতিটি প্রোটিন ও প্রতিটি ভেসিকলের পারস্পরিক ক্রিয়া রেকর্ড করা সম্ভব হয়েছে। আক্ষরিক অর্থে এক ‘আণবিক সিনেমা’ তৈরি হয়েছে। তাদের পরীক্ষায় দেখা গেছে, ফ্লুরোসেন্ট ডাই (রঙিন আলোকিত অণু) ঝিলিকা ফুঁড়ে বাইরে বেরিয়ে আসছে- যা এই গর্ত তৈরির প্রমাণ। এই পদ্ধতি ভবিষ্যতে ওষুধ পরীক্ষার ক্ষেত্রেও কাজে লাগতে পারে, কারণ বিভিন্ন যৌগ প্রয়োগ করে দেখা যাবে কোনটি এই গর্ত-গঠন প্রতিহত করতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, গর্ত তৈরি হয় বিশেষত মাইটোকন্ড্রিয়ার মতো ঝিলিকায় অর্থাৎ কোষের শক্তি উৎপাদক কেন্দ্রে। ফলে প্রাথমিক ক্ষয় শুরু হয় কোষের শক্তির উৎসস্থল থেকেই। বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যে কিছু ক্ষুদ্র আকারের অ্যান্টিবডি অংশ পরীক্ষা করেছেন, যেগুলি অলিগোমারকে আঁকড়ে ধরতে পারে। যদিও এখনও গর্ত-গঠন পুরোপুরি রোধ করা যায়নি, তবে এটি রোগ শনাক্তকরণের ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।

 

সূত্র : “Single-vesicle Tracking of α-Synuclein Oligomers Reveals Pore Formation by a Three-Stage Model” by Bo Volf Bro̷chner, Xialin Zhang, Janni Nielsen, Jo̷rgen Kjems, Daniel E. Otzen and Mette Galsgaard Malle, 12 August 2025, ACS Nano.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

nine + twelve =