
প্রকৃতির বহুবৈচিত্র্য, মানব সভ্যতার অস্তিত্বের অন্যতম প্রধান ভিত্তি। জীববৈচিত্র্যের মাধ্যমেই পৃথিবীর পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় থাকে, খাদ্যশৃঙ্খল পরিচালিত হয়, মানবজাতি পায় প্রয়োজনীয় জিন সম্পদ। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক আবাসস্থল ধ্বংস, দূষণ ও অবাঞ্চিত শিকার ক্রমে এই বৈচিত্র্যকে বিপন্ন করে তুলছে। সাম্প্রতিক গবেষণা ও উদ্যোগগুলো জোর দিচ্ছে পৃথিবীর ‘জিনগত ভবিষ্যৎ’ রক্ষার উপর। কারণ, সময় শেষ হয়ে আসছে।
প্রতিটি প্রাণী, উদ্ভিদ কিংবা অণুজীবের জিনোমে ভবিষ্যতের অভিযোজন ক্ষমতা নিহিত থাকে। যেমন, কোনো ফসলের জিন বৈচিত্র্যই নির্ধারণ করে সেটি নতুন রোগ প্রতিরোধ করতে পারবে কিংবা পরিবর্তিত জলবায়ুর সাথে মানিয়ে নিতে সক্ষম হবে কিনা। জিনের বৈচিত্র্য হ্রাস পেলে প্রজাতি সহজেই বিলুপ্তির ঝুঁকিতে পড়ে। কৃষি থেকে শুরু করে চিকিৎসা গবেষণা- সবক্ষেত্রে এই বৈচিত্র্যের উপর নির্ভরশীল মানবসমাজ। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংঘের তথ্যে দেখা যায়, পৃথিবীর হাজার হাজার প্রজাতি ইতোমধ্যেই বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। যখন কোনো প্রজাতি হারিয়ে যায়, তখন শুধু তার অস্তিত্বই নয়, তার অন্তর্নিহিত জিন সম্পদও চিরতরে হারিয়ে যায়। গবেষকদের মতে, প্রতিটি প্রজাতির ভিতরের অগণিত জিন আমাদের অজানা রোগের চিকিৎসা, নতুন খাদ্য উৎস কিংবা পরিবেশগত প্রতিরোধ ক্ষমতার চাবিকাঠি বহন করতে পারে। ফলে, সেই সম্ভাবনাগুলিও ধ্বংস হয়। এই বিপদের মোকাবিলায় বিভিন্ন দেশে জিন ব্যাংক বা জিনোম ভান্ডার প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। যেমন, নরওয়ের স্বালবার্ড গ্লোবাল সিড ভল্টে লাখ লাখ বীজ সংরক্ষিত আছে, যা ভবিষ্যতের কৃষি নিরাপত্তার জন্য অমূল্য। একইভাবে প্রাণীর কোষকলা, কোষ ও ডি এন এ নমুনা সংরক্ষণে কাজ করছে একাধিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান। আধুনিক বায়োটেকনোলজি যেমন ক্রায়োপ্রিজারভেশন (শীতল অবস্থায় সংরক্ষণ প্রযুক্তি) ও জিনোম সিকোয়েন্সিং এই কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। জিনোম সিকোয়েন্সিং প্রযুক্তি গবেষকদের সাহায্য করছে জীববৈচিত্র্যের মানচিত্র তৈরি করতে। এর মাধ্যমে বোঝা যাচ্ছে কোন প্রজাতি বেশি বিপন্ন এবং কোথায় সংরক্ষণ প্রচেষ্টা আরো জোরদার করা প্রয়োজন। তবে প্রযুক্তি দিয়ে সবকিছু রক্ষা করা সম্ভব নয়।
প্রাকৃতিক আবাসস্থলের ধ্বংসসাধন ও জলবায়ু পরিবর্তন অব্যাহত থাকলে শুধু নমুনা সংরক্ষণই যথেষ্ট হবে না। বাস্তব পরিবেশে প্রজাতিগুলোকে টিকিয়ে রাখাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, জিনগত ভবিষ্যৎ রক্ষা কেবল বিজ্ঞানীদের দায়িত্ব নয়, এটি আন্তর্জাতিক সহযোগিতার বিষয়। আইনগত কাঠামো, অর্থ বরাদ্দ ও নীতিনির্ধারণে বিশ্বজুড়ে ঐকমত্য হওয়া জরুরি। একইসঙ্গে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তারাই তো প্রকৃত অভিভাবক। প্রতি বছর যেভাবে প্রজাতি হারিয়ে যাচ্ছে, তাতে গবেষকরা সতর্ক করেছেন , এখনই ব্যবস্থা না নিলে অনেক সম্পদ আর কখনও ফিরে পাওয়া যাবে না। পৃথিবীর জিনগত ভবিষ্যৎ আসলে মানবসভ্যতার ভবিষ্যৎও বটে। একে রক্ষা করা মানে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য এবং পরিবেশগত স্থিতিশীলতাকে সুরক্ষিত করা।
সূত্র : The Earth BioGenome Project Phase II: illuminating the eukaryotic tree of life by
Mark Blaxter, Frontiers in Science (04 September 2025)