
প্রাণী, উদ্ভিদ, জীবাণু সবাই পরস্পরের মধ্যে ক্রমাগত যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছে। কখনো সংকেতের মাধ্যমে, কখনো গন্ধ সনাক্তকরণের মাধ্যমে, আবার কখনো তাপমাত্রা পরিবর্তনে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে। এই যোগাযোগ মাধ্যম অনেক সময়ই অদৃশ্যভাবে পরিচালিত হয়। একটি নতুন গবেষণা, প্রাণীদের এই মিথস্ক্রিয়া সম্পর্কে আমাদের ধারণাকে আরো প্রসারিত করেছে। জার্মান সেন্টার ফর ইন্টিগ্রেটিভ বায়ো ডাইভারসিটি রিসার্চ -এর বিজ্ঞানীরা জানান, “বাস্তুতন্ত্রগুলি এক বিশাল তথ্য আদান-প্রদান ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে।” গবেষকরা একে ‘প্রকৃতির ইন্টারনেট বা আন্তর্জাল’ বলে অভিহিত করেছেন। এই গবেষণা প্রাণিসম্প্রদায়গুলির মধ্যে তথ্যের আদান-প্রদান এবং তার দরুন পরিবেশের ভারসাম্য কিভাবে প্রভাবিত হয়- সে বিষয়ে আলোকপাত করেছে। ধারণাটি বাস্তুতন্ত্রের তত্ত্বে বিপ্লব আনতে পারে। বিগত কয়েক দশক ধরে, বাস্তুতন্ত্রবিদরা খাদ্যজালের মানচিত্র তৈরি করছেন এবং শক্তি স্থানান্তর পর্যবেক্ষণ করছেন। কোন ক্ষেত্রে কোন প্রাণী শিকার বা শিকারি, বীজ বহনকারী কিংবা ফুলের পরাগায়ন করে তা পর্যবেক্ষণ করছেন। তথ্যগুলির উপর ভিত্তি করে এমন এক মডেল তৈরি হয়েছে যা বাস্তুতন্ত্রের উপর প্রজাতিগুলির ভূমিকা এবং শক্তির বন্টনকে ব্যাখ্যা করে। কিন্তু শুধুমাত্র ভৌত সংযোগের উপর মনোনিবেশ করলে গুরুত্বপূর্ণ কিছু অংশ বাদ পড়ে যায়। তথ্য সংযোগের মধ্যে রয়েছে সর্তকতা ইঙ্গিত এবং সংকেত। প্রাণী প্রজাতিগুলি কিভাবে স্থিতিশীল থাকে বা ভেঙে পড়ে সেগুলি এই তথ্যসংযোগের উপরে নির্ভর করে। “প্রকৃতির আন্তর্জালের মাধ্যমে এই তথ্যপ্রবাহকে বিবেচনা না করে প্রাকৃতিক বাস্তুন্ত্রের প্রক্রিয়াগুলি বুঝতে চাওয়া, খানিকটা মানবসমাজে ইন্টারনেটকে বাদ দিয়ে তথ্যের সরবরাহ বোঝার চেষ্টা করার সমান”, প্রধান গবেষক উলি ব্রোস বলেন। এই দৃষ্টিভঙ্গি জটিলতার সাথে বাস্তবতাকেও সংযুক্ত করে। আসলে, বাস্তুতন্ত্র তো কেবল ভোগের শৃঙ্খল নয়। বরং এই শৃঙ্খলার মধ্যেই পর্যবেক্ষক, শ্রোতা, প্রতিক্রিয়া-দাতাদের অভিযোজন লুকিয়ে থাকে।
গবেষকরা প্রকৃতিতে তিন ধরনের তথ্যসংকেত সনাক্ত করেছেন। খাদ্য, জল বা বীজ সরবরাহ, আশেপাশের পরিবেশের সাথে তাদের মিথস্ক্রিয়া এবং শিকারি- শিকারের পারস্পরিক ক্রিয়া সম্পর্কিত সংকেত । উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে, নেকড়েরা এল্কদের খুঁজে পেতে চিহ্ন বা চাক্ষুষ চিহ্ন ব্যবহার করে। আবার এল্করা বিপদ টের পেলে একসাথে জড়ো হয় কিংবা একটি এলাকায় লুকিয়ে পরে। কোনো আচরণই কিন্তু সরাসরি যোগাযোগের সাথে যুক্ত নয়। ইঙ্গিতের মাধ্যমেই তারা তথ্য বিনিময় করে। যে সমস্ত প্রজাতির মধ্যে সরাসরি মিথস্ক্রিয়া ঘটে না তাদের মধ্যে বিশুদ্ধ তথ্য সংযোগ তৈরি হয়। যেমন, একটি হায়েনা যখন মাথার উপরে শকুন ঘুরতে দেখে তখন সে বুঝে যায় শিকার খুব দূরে নেই। সে তখন শকুনকে অনুসরণ করে, নীরব ইঙ্গিতগুলি বুঝে নিয়ে সুযোগের দিকে বা ঝুঁকির থেকে দূরে সরে যায়। পরিবেশগত তথ্যের সংযোগ পরিবেশের সংকেত থেকেই তৈরি হয়। তাপমাত্রা, আলো বা শব্দ পরিবর্তন এক্ষেত্রে সংকেতের কাজ করে। পতঙ্গরা কৃত্রিম আলোর দিকে উড়ে যায়, মাকড়সারা বাতির কাছে জাল বাঁধে, গিরগিটিরা পটভূমির রঙের সাথে মানিয়ে নিয়ে ত্বকের রং বদলে ফেলে। এসবই তাদের চারপাশের জগতের প্রতি সাড়া দেওয়া। প্রকৃতিতে সংকেত শৃঙ্খলের সাথে খাদ্যশৃংখল একত্রিত করার ধারণাটি বিজ্ঞানীদের বাস্তুতন্ত্রের স্থিতিস্থাপকতার দৃষ্টিভঙ্গিকে বদলে দেয়। দাবানল বা আক্রমণাত্মক প্রজাতি যখন কোনো ব্যাঘাতের সৃষ্টি করে, তখন তথ্যগুলি অন্যরকম ভাবে কাজ করে। সেক্ষেত্রে প্রজাতিগুলি দ্রুত বিপদ এড়াতে নির্ভরযোগ্য তথ্য ভাগ করে নেয় এবং আচরণগতভাবে খাপ খাইয়ে নেয়। যখন যোগাযোগ মাধ্যম ভেঙে যায় তখন বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়ে। কাগজেকলমে খাদ্যশৃঙ্খলের অস্তিত্ব থাকলেও, বাস্তবে এই অদৃশ্য যোগসূত্রগুলোকে বোঝাটাই গুরুত্বপূর্ণ। বাস্তুতন্ত্রের উপাদান এবং তথ্যপ্রবাহ, উভয়কেই সঠিকভাবে অনুসরণ করতে পারলে, ব্যবস্থাপনাগুলি কিভাবে পরবর্তীতে বদলাতে পারে তার ভবিষ্যৎবাণী করা সম্ভব। প্রকৃতির আন্তর্জালের উপর সবথেকে বড় হুমকি হলো, প্রাণীদের এলাকায় মানুষের অনুপ্রবেশ। এর জন্য তারা যে কেবল আবাসস্থল পরিবর্তন করে তা নয়, তাদের যোগাযোগের মাধ্যমগুলিও ব্যাহত হয়ে পড়ে। কৃত্রিম আলো, শিল্প, শব্দ এবং রাসায়নিক দূষণ যোগাযোগের পথে জটিলতা বাড়ায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, “পিঁপড়েরা তাদের কাজ করার জন্য কম্পন সংকেত ব্যবহার করে, কিন্তু সড়ক যানজট বা শিল্প কাঠামো এই সংকেত ব্যবহারে জটিলতা আনে”। যখন এই সংকেতগুলি অবরুদ্ধ হয় বা ব্যর্থ হয় তখন তাদের প্রজনন এবং খাদ্যের ধরন পরিবর্তিত হয়। তার সাথে সাথে পরিবেশগত সমস্যা সৃষ্টি হয়। এক্ষেত্রে খুব সাধারণ নিদর্শন হল, ইঞ্জিনের শব্দে ব্যাঙের পুকুর থেকে মিলনের ডাক ঢেকে যাওয়া ফলে পুকুরটি তাদের কাছে অকেজো হয়ে পড়ে।বিভিন্ন সংরক্ষণ প্রচেষ্টা প্রায়শই প্রাণীদের আবাসস্থল সংরক্ষণ এবং শিকার বন্ধ করার উপরে জোর দেয়। কিন্তু প্রজাতিগুলির মধ্যে সংকেত প্রবাহ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যার দিকে এবার মনোযোগ দেওয়ার সময় এসেছে। ব্রোস বলেন, “প্রকৃতির আন্তর্জালের হিসাব রাখতে পারলে জীবজগতে প্রাণী উদ্ভিদ এবং জীবাণু কিভাবে কাজ করে সে সম্পর্কে রসায়ন এবং পদার্থবিদ্যার নিষ্ক্রিয় কণা চলাচলের ধারণা কাজে লাগিয়ে প্রানিদের তথ্য উৎপাদন এবং ব্যবহারের উপর আরো বাস্তব সম্মত জোর দেওয়া যাবে”। আমরা যদি প্রকৃতিকে রক্ষা করতে চাই, তাহলে অবশ্যই এই সংকেতগুলিকেও রক্ষা করতে হবে। শব্দ কমানো, জোরালো আলো ব্যবহার কমানো, প্রাকৃতিক ছন্দ বজায় রাখা প্রভৃতির দিকে নজর দিতে হবে। বাস্তুতন্ত্র তো কেবল খাদ্য-খাদকের সম্পর্ক নয়। বরং যা দেখা যায়, শোনা যায়, যার গন্ধ পাওয়া যায় বা যা অনুভব করা যায় সে সব নিয়েই বাস্তুতন্ত্র গঠিত। কোন একটি ব্যাহত হলে গোটা শৃঙ্খালই ধ্বসে পড়বে।