প্রাণীজগতে শক্তির ব্যবহার একরকম অর্থশাস্ত্রের বাজেটের মতো। সেখানে প্রতিটি শারীরিক কার্যের আলাদা আলাদা শক্তিমূল্য ধার্য আছে। সন্তান উৎপাদন সেই বাজেটের সবচেয়ে ব্যয়বহুল খাত। সেই শক্তি যদি দেহ মেরামত, রোগ প্রতিরোধ বা বার্ধক্য ধীর করার কাজে ব্যয় হতো, তাহলে প্রাণীটি আরও অনেক দিন বাঁচতে পারত। দীর্ঘদিনের এই তত্ত্বকেই এবার নতুন করে প্রমাণসিদ্ধ করল নিউজিল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব ওটাগোর নেতৃত্বাধীন এক ব্যতিক্রমী গবেষণা।
বিশ্বব্যাপী চিড়িয়াখানা ও অ্যাকোয়ারিয়ামে রক্ষিত ১১৭টি স্তন্যপায়ী প্রাণীর জীবনপর্যায়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে গবেষকেরা দেখেছেন—যখন হরমোনের মাধ্যমে জন্মনিয়ন্ত্রণ, অস্ত্রোপচার বা যেকোনো পদ্ধতিতে প্রজনন থামানো হয়, তখন প্রাণীদের আয়ু গড়ে ১০ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। এটি শুধু একটি সাধারণ প্রবণতা নয়; বরং পুরুষ ও স্ত্রী প্রাণী—দুই ক্ষেত্রেই এর আলাদা জৈবিক ব্যাখ্যা রয়েছে।
পুরুষ প্রাণীদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে —ক্যাসট্রেশন/নির্বীজকরন, অর্থাৎ অণ্ডকোষ অপসারণই আয়ু বাড়ানোর সবচেয়ে কার্যকর উপায়। ভ্যাসেকটমির মতো পদ্ধতি, যা শুধু প্রজননের ক্ষমতা রোধ করে কিন্তু পুরুষ হরমোন/টেস্টোস্টেরন উৎপাদনকে অক্ষত রাখে, সেখানে দীর্ঘায়ুর কোনো প্রভাব দেখা যায়নি। এর অর্থ, যৌন হরমোনই বার্ধক্যের গতিকে ত্বরান্বিত করে, বাড়ায় আগ্রাসী আচরণ, লড়াই, আঘাত কিংবা ঝুঁকিপূর্ণ আচরণের সম্ভাবনা। কম বয়সে এই হরমোন দমন করলে আয়ু বৃদ্ধির প্রভাব আরও স্পষ্ট হয়।
স্ত্রী প্রাণীদের ক্ষেত্রে চিত্রটি ভিন্ন। এখানে মূল ভূমিকা হরমোনের নয়; বরং গর্ভধারণ, প্রসব, স্তন্যদান ও সন্তান লালনের বিপুল শক্তি-ব্যয় কমে যাওয়াই আয়ু বৃদ্ধির প্রধান কারণ। প্রজনন বন্ধ হলে সেই চরম শারীরিক চাপ কমে যায়, ফলে রোগ প্রতিরোধ শক্তি ক্ষয় হয় না এবং সংক্রমণজনিত মৃত্যুঝুঁকিও কমে।
পুরুষদের ক্ষেত্রে কখন হরমোন উৎপাদন কমানো হলো, সেটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এদের ক্ষেত্রে কম বয়সে হরমোন উৎপাদন বন্ধ হলে লাভ বেশি দেখা যায়। আর স্ত্রী প্রাণীদের ক্ষেত্রে জীবনের যেকোনো পর্যায়ে প্রজনন থামানোই লাভজনক। চিড়িয়াখানার চিকিৎসা-সুবিধা ও নিরাপত্তা এই পার্থক্যগুলো আরও স্পষ্টভাবে বুঝতে সাহায্য করেছে—যা প্রাকৃতিক পরিবেশে বোঝা প্রায় অসম্ভব।
এ গবেষণা মানুষের জীবনচক্রকেও নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করে। মধ্যবয়সে প্রজনন থামিয়ে দেওয়া—অর্থাৎ মেনোপজ—হয়তো শুধুই জীববৈজ্ঞানিক বাস্তবতা নয়; বরং বেঁচে থাকার কৌশলও হতে পারে।
এই গবেষণাটি আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সতর্ক করে যে, দীর্ঘায়ু পাওয়া মানেই সুস্থ বার্ধক্য নয়। কোন পদ্ধতিতে প্রজনন বন্ধ করা হয়েছে এবং কোন হরমোন সক্রিয় রয়ে গেছে, তার ভূমিকা ভবিষ্যৎ স্বাস্থ্যের গুণগত মান নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ।
সূত্র : Sterilization and contraception increase lifespan across vertebrates by Michael Garratt, Malgorzata Lagisz ,et.al; published in Nature journal,10th December 2025.
