বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিজ্ঞানের দুই উজ্জ্বল তারকার সান্নিধ্যে এসেছিলুম প্রায় কৈশোরকাল থেকেই – এঁরা হলেন সত্যেন্দ্রনাথ বোস আর প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ।অবশ প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশের সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম অনেকটা পরে, যখন আমি লণ্ডনের কিংগসে গবেষণার কাজে কয়েক ধাপ এগিয়ে গেছিলুম। কিন্তু সত্যেন বোসের সান্নিধ্য পেয়েছিলুম সেই কৈশোরেই আমাদের মুর্শিদাবাদের কাঁদির বাড়িতে। উনি আমাদের স্কুলের বিজ্ঞান ভবনের উদ্বোধনে এসেছিলেন।
দুজনেই প্রায় সমবয়সী ছিলেন, এমনকি প্রেসিডেন্সিতেও ওনারা মোটামুটি একসাথেই ছিলেন। দুজনেই আবার জগতবিখ্যাত পরিসংখ্যানবিদ। প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ ছিলেন সনাতন পরিসংখ্যানবিদ। বড় মাপের নমুনার ওপর পরিসংখ্যান তত্ত্ব প্রয়োগ করে উনি নিজের কৃতিত্বের পরিচয় দেন। এর পাশাপাশি রয়েছে তাঁর D2 তত্ত্ব যা আজও তাঁকে স্মরণ করায়। অন্যদিকে কোয়ান্টাম পরিসংখ্যানে সত্যেন বোসের অগ্রণী ভূমিকা বলাই বাহুল্য। আর ফোটন অর্থাৎ আলোক কণায় কোয়ান্টাম প্রয়োগই তো জন্ম দিল বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যানের। মৌলিক কণাগুলির মধ্যে যাদের কোয়াণ্টাম স্পিন শূন্য অথবা এক, তারা বোস পরিসংখ্যান মেনে চলে- তারা হল বোসন। সাম্প্রতিক যে বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেশান আবিষ্কার হয়েছে তার ধারণা এই বোস পরিসংখ্যানই দিয়েছিল অনেক আগেই।
খুব সংক্ষিপ্ত আকারে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশের সম্পর্কে কিছু কথা তুলে ধরতে চাই । আমি অবশ্য পরিসংখ্যানবিদ্যায় ওনার অবদান নিয়ে বিশেষ কিছু বলতে চাই না – অনেক গুণীজন আছেন যারা ঐ বিষয়ে আমার থেকে অনেক বেশী পারদর্শী । বরং আমি ওনাকে নিয়ে আমার নিজস্ব কিছু স্মৃতিচারণ করতে চাই ।
ওনার প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করতে গিয়ে প্রথমেই মনে আসে ভারতীয় পরিসংখ্যান সংস্থানের কথা । এই প্রতিষ্ঠানটি আজও শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার । ভারতবর্ষে উনিই পরিসংখ্যানবিদ্যার আগমন ঘটান । শুধু তাই নয়, উনি ভারতবর্ষকেই বিশ্বপরিসংখ্যানের মানচিত্রে হাজির করেন ।
আই এস আই-কে কেবল পরিসংখ্যানেই সীমাবদ্ধ রাখেন নি – একদিকে যেমন পদার্থবিজ্ঞানীদের আনাগোনা – তেমনি অন্যদিকে নাট্যজগতের কলাকুশলীদেরও যোগাযোগ ছিল । এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও মাঝেমধ্যেই আসতেন এখানে । ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, যাদুঘরের পাশাপাশি এই প্রতিষ্ঠানটিও ছিল এক দর্শনীয় স্থান । সত্যিই এ এক অনন্য প্রতিষ্ঠান । বিজ্ঞানের এই প্রতিষ্ঠানটি কিন্তু বিজ্ঞান – প্রযুক্তি মন্ত্রকের অধীনস্থ নয় – এটি হল পরিকল্পনা মন্ত্রকের অধীন ।
প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ আবেগের সাথে অত্যন্ত দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন কম্পিউটারের ব্যাপারে সেই আমলেই । টি আই এফ আর, পরমাণুশক্তি বিভাগের প্রতিষ্ঠানের তাবড় তাবড় বিজ্ঞানীরাও আসতেন কোলকাতার এই আই এস আই-তে । মেশিনের বুদ্ধিমত্তা, ‘প্যাটার্ন রিকগনিশান’ এসবই এখানে আজও বেশ জোরালো ।
এখনও মনে পড়ে, লন্ডন থেকে যখন ছুটিতে এদেশে এলুম, তখনই প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশের সাথে যোগাযোগের কথা মাথায় আসে । উনি তখন দিল্লিতে ছিলেন । ওনার টেলিফোন নম্বর পেয়ে লেখালিখি না করে সরাসরি যোগাযোগ করলাম – ওনার সাথেই কথা হল ।
সৌভাগ্যবশত আমার শ্রদ্ধেয় জ্যাঠামশাই বিমলচন্দ্র সিংহ ছিলেন ওনার বন্ধুস্থানীয়, কাজেই আমার সম্পর্কে ওনার কিছুটা হলেও ধারণা ছিল । টেলিফোনে কথা হবার দিনসাতেক পরেই আম্রপালিতে একদিন মধ্যাহ্নভোজের নিমন্ত্রণও পেয়ে গেলাম ।
আম্রপালি আমাকে যাদুমন্ত্রের মতো আকৃষ্ট করেছিল – ভারী সুন্দর, অবিশ্বাস্যভাবে রবীন্দ্রভাবনায় পরিপূর্ণ । সেখানকার সমস্ত বাতাবরণ, এমনকি প্রতিটি আসবাব অদ্ভুতভাবে স্মরণ করায় গুরুদেবকে । সংক্ষিপ্ত আলাপ-আলোচনা সেরেই সোজা চলে গেলাম খেতে । রাণী মহলানবীশও কিন্তু বেশ মহীয়সী মহিলা । আমি তখন বেশ কমবয়সী – কিন্তু আমি দেখলাম এতে ওনাদের কোনও সমস্যাই হল না । টেবিলে প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের সম্মীলন – এরকম আয়োজন কিন্তু শান্তিনিকেতনের রতন কুটিরের ।
আমি দেখলাম ওনারা দুজনেই ছুরি আর কাঁটাচামচ দিয়েই খাচ্ছেন । প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ বেশ ভালোই ভোজনরসিক ছিলেন । খেতে খেতেই আলাপ বেশ জমে উঠেছিল । এটা সত্যিই আমার কাছে এক বিরাট প্রাপ্তি । কিংগস, লন্ডনে আমি কী করে, সেই সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছিলেন । আমিও বেশ ভালভাবেই বললাম যে ওখানে পি এইচ ডি সেরে আমি শিক্ষকতার সাথে নিউক্লিয়ার পদার্থবিদ্যায় গবেষণার কাজ চালিয়ে যাচ্ছি । উনি হঠাৎ করে বলে বসলেন যে আমি দেশে ফিরে যেন আই এস আই-তে যোগ দিই । এরপর সোজা ওনার নিজের পড়ার ঘরে চলে গেলাম । উনি বার বার বেল বাজাচ্ছিলেন – কিন্তু কেউ এলো না । হঠাৎ রাণী মহলানবীশ সেখানে হাজির এবং বিশুদ্ধ বাংলায় বললেন – ‘ জান বিকাশ, কবি আমাকে গেঁয়ো মেয়ে বলতেন, দুপুরে ভোঁসভোঁস করে ঘুমাই বলে’ – তারপর উনি বোঝাবার চেষ্টা করলেন যে উনি এখন ঠিক সেইটিই করতে যাচ্ছেন ।
যখন পাইকপাড়ার বাড়িতে ফিরলুম, তখন মাথায় শুধু ওনাদের অসাধারণ আতিথেয়তা আর অভিভূতকারী রবীন্দ্রপরিবেশ ঘুরপাক খাচ্ছে ।
তারপর আমি লন্ডনে ফিরলুম, সবই যেন স্মৃতি ।
একদিন সকালে আমাদের গবেষণাগারের টেলিফোনটি বেজে উঠলো, সহকারী এক ভদ্রমহিলা বেশ উচ্ছ্বসিত গলায় জানালেন যে এক বিখ্যাত ভারতীয় অধ্যাপক রয়াল সোসাইটিতে আমাকে ডেকেছেন । মনে মনে ভাবলুম ইনি প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ ছাড়া আর কে হতে পারেন । বিন্দুমাত্র কালক্ষেপ না করেই ছুটে গেলুম রয়াল সোসাইটি । সহকারী একজনকে জানালুম আমার আসবার উদ্দেশ্য । শুনে তিনি বললেন – “ ওওও… তার মানে আপনি ঐ লম্বা মতন ভদ্রলোক যিনি এক ভারতীয় মহিলার সাথে আছেন তাঁর কথা বলছেন ?’’ আমি খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললুম ‘আজ্ঞে হ্যাঁ’ । আসলে এঁরা হলেন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ আর রাণী মহলানবীশ ।
খানিকক্ষণ অপেক্ষা করেই দেখা হয়ে গেল । কিছুক্ষণ পরেই বাংলাতেই বললেন, ‘ অক্সফোর্ড স্ট্রিটের দিকে যাওয়া যাক’ । আমি একটু বিস্মিতই হলাম । আসলে অক্সফোর্ড স্ট্রিট তো দোকানপাটে ভরা, বিশেষত ভারতীয় যারা বিলেতে এসে বিলিতি জামাকাপড় কেনে তারাই এখানে আসে । কিন্তু সেখানে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশের কী কাজ ?
ওনার পরনে ছিল বেশ পুরোনো কিন্তু ভারী চমৎকার জ্যাকেট, সাথে ওয়েস্ট কোট, ধূসর ট্রাউজার, ওয়েস্ট কোটের পকেটে সোনার চেন দেওয়া ঘড়ি- যেন উনবিংশ শতাব্দীর কেমব্রীজ বা অক্সফোর্ডের ‘ডন’।
হ্যাঁ, আমরা এলাম অক্সফোর্ড স্ট্রিটেই, কিন্তু জামাকাপড় নয় বরং এক চক্ষু বিশেষজ্ঞের কাছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ লন্ডন বেশ ভালোভাবেই চিনতেন। আমরা দুই তিন তলা ওপরে এলাম। লন্ডনবাসী একটি কমবয়সী মেয়ে জিজ্ঞেস করল ‘আপনার নাম কি …স্যার’। লণ্ডনের ভঙ্গিতে মেয়েটি বলল ‘মহলানবীশ…? মাফ করবেন, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না’। বেশ কিছুক্ষণ চলল ব্যাপারটা। আমি থাকতে না পেরে একটুকরো কাগজ চেয়ে নিয়ে নামটা লিখে দিলুম। ‘ওহ… ম-হ-লো-ন-বীশ?’ প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, ‘এটা হবে মহলানবীশ’- এভাবেই চলছিল। এর মধ্যে নাক গলাতে আমি বাধ্য হলাম, কারণ মধ্যাহ্নভোজের সময় হয়ে এসেছে, রানী মহলানবীশ নিশ্চয়ই অপেক্ষা করছেন। কোনোমতে আমি ওনাকে মেয়েটির খপ্পর থেকে বের করে আনলুম। অক্সফোর্ড স্ট্রিটে এসেই উনি রাস্তার উল্টোদিকে একটা ট্যাক্সিকে লক্ষ করে চিৎকার জুড়লেন- ‘ট্যা…ক্সি’। গোটা অক্সফোর্ড স্ট্রিট থমকে গেল, লন্ডনের লোকেরা মনে হয় কোনোদিন এরকম চেহারার লোক দেখেনি, তাই দাঁড়িয়ে হাঁ করে দেখছে। ট্যাক্সিটাও থেমে গেল। যখন রয়াল সোসাইটিতে ফিরলাম, দেখি রাণী মহলানবীশ আই এস আই-র কোন এক প্রাক্তন সহকর্মীর সাথে সরষের তেল নিয়ে পড়েছেন। আমার কাছে ব্যাপারটা বেশ লাগল, লন্ডনের কাল্টন স্ট্রিটে একটু বাঙালি ছোঁয়া।
হাইকমিশনের গাড়িতে আসা সেই ভারতীয় হাই কমিশনের লোকটি বেশ ক্ষুব্ধ হয়েই জানালেন এয়ার ইন্ডিয়ার নিউ ইয়র্কগামী বিমানের জন্য তাদের দেরী হচ্ছে। তাই বিশেষ বাক্যব্যয় না করে গাড়িতে চেপে বসল। যেতে যেতে আমার দিকে অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাকিয়ে গেল, কে জানে- তার আসল কারণ হয়তো সরষের তেলের সেই বিখ্যাত মহিলাই।
এদিকে রাণী মহলানবীশও বেশ খানিকটা বুদ্ধিভ্রষ্টই মনে হল। যাই হোক, কোনোমতে বিদায় জানিয়ে আমি কিংগস ফিরে এলুম।
খুব কম দিনের জন্য আমি একবার বোম্বেতে এসেছিলুম ডঃ রাজা রামান্নার সাথে দেখ আকরতে। বার্কে-র বাসে চেপে ট্রম্বে যাবার পথে পত্রিকায় হঠাৎ দেখি যে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ আর নেই। ২৯শে জুন, ১৯৭২, ওনার বয়স ৭৯ হওয়ার কথা কিন্তু তার একদিন আগেই ওনার মৃত্যু ঘটল কলাতার এক নার্সিংহোমে। বোম্বের মৌসুমীবায়ু যেন জানালার কাচে কশাঘাত করছে।
মহান এক ব্যক্তিত্ব, প্রচণ্ড সমৃদ্ধ, অসম্ভব মেধাবী, অদম্য এক প্রতিষ্ঠাতা, অসামান্য এক কান্ডারী চলে গেলেন। এর সাথে সাথে আমার আই এস আই-তে যোগ দেবার প্রত্যাশাও বিলীন হয়ে গেল।