প্রশ্ন

প্রশ্ন

অভিজিৎ কর গুপ্ত, পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক, পাঁশকুড়া বনমালী কলেজ
Posted on ১১ জানুয়ারী, ২০২৫

আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় প্রশ্ন করার খুব একটা চল নেই। এই সিস্টেম, ওই সিস্টেম, সিলেবাসের বিশাল বোঝা, নানান রকমফের, হরেকরকম পরীক্ষাপদ্ধতি আর মূল্যায়ন করার নানান কায়দা – পাশ-ফেল, নম্বর পাওয়া, পার্সেন্ট-এর হিসাব, পার্রসেন্টাইল, র‍্যাঙ্ক, গ্রেড দিয়ে মূল্যায়ণ এরকম কত কী হিসাব নিকাশ। আসলে কিছু শেখা যাচ্ছে কিনা, তা নিয়ে ভাবনার তেমন অবকাশ নেই। গালভরা নাম যাই দাও, শেষে সব মুখস্থ!

কলেজে যখন পড়তাম, আমাদের এক স্বনামধন্য মাষ্টারমশাই বলতেন, আগে প্রশ্ন করতে শেখো! বকা খেয়েও আমাদের চৈতন্য ফিরত না।

সেদিন অন্য একটা বিভাগের ছেলেমেয়েদের জন্য আমাদের পদার্থবিদ্যা বিভাগ থেকে অফার করা একটা বিষয়ের ক্লাস নিচ্ছিলাম। MDC (Multi Disciplinary Course)-এর ক্লাস! আমরা ঠিক করেছিলাম, জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকার-এর লেখা বই, “The Structure of the Universe” থেকে প্রথম কয়েকটা চ্যাপ্টার ধরে ধরে তাদের পড়াবো। সেরকম ডিটেইলস-এ পড়ানোর অবকাশ নেই। শুধু একটু ধারণা দেওয়া। তারপর তো গুগুল, ইউটিউব, চ্যাটজিপিটি আছেই। ভাবলাম, পড়তে পড়তে যাওয়া যাক আর তার মধ্যের বেসিক ফিজিক্স পার্টটা ক্লিয়ার করতে করতে এগোনো যাক। এই হলো প্ল্যান। বইটার পিডিএফ কপি ছাত্রছাত্রীদের সবার মোবাইলে। ক্লাসে যা পড়াই তাই তারা শোনে, তবে নিজেরা আর বাড়িতে গিয়ে পড়ে বলে মনে হয় না। একদিন বললাম, তোমরা এইখান থেকে এইটুকু শুধু পড়ে আসবে। শুধু রিডিং পড়বে, আর ভাববে এখান থেকে কী কী প্রশ্ন হতে পারে। পরের দিন ক্লাসে এসে জিজ্ঞেস করতে গিয়ে বুঝলাম তারা প্রায় কেউই পড়ে নি। আমার বলার অপেক্ষায় রয়েছে। এবার আমিই ক্লাসে একটু করে রিডিং পড়ি আর বলতে থাকি, দ্যাখো, এখান থেকে এইরকম একটা প্রশ্ন বানানো যায়। একটা ছোট প্রশ্ন, একটা বড় প্রশ্ন, একটা ইনফরমেশান, একটা আইডিয়া। এখান থেকে আরেকটু এগোলে আরো একটা প্রশ্ন… এভাবেই তোমরাও ভাবতে থাকো। এতে কাজ হলো। অমনি সব সামনে এগিয়ে এসে মন দিয়ে শুনতে থাকলো। পরীক্ষার প্রশ্ন বলে কথা!

এই প্রশ্ন তৈরি করাটা শেখার একটা উপায়। পরের দিন ক্লাসে এসে বললাম, তোমরাই সবাই মিলে প্রশ্ন করবে, ছোট বড় যার যেরকম মনে হয়। কোন প্রশ্নের উত্তরে কত নম্বর দেওয়া যায়, তোমরাই ঠিক করবে। উত্তর তো বই খুঁজলেই পাবে। সবাই আমাকে প্রশ্ন জমা করবে। আর, তোমাদের এইসব প্রশ্ন থেকেই সিলেকশান করে প্রশ্নপ্ত্র তৈরি হবে। ওরা বেশ অবাক! তবে, মনে হয়, এই প্রশ্ন বানাতে দেওয়ার আইডিয়াটা বেশ কাজে এলো। সবাই মন দিয়ে নোটস নেওয়া শুরু করলো। প্রশ্নের মতো করে কিছু বলতেই খাতায় কলম চলতে শুরু করলো ওদের। এবার প্রশ্ন কী করে বানানো যাবে, তাই নিয়ে জল্পনাকল্পনা শুরু করলো ওরা। ব্যাপারটা মন্দ নয়। সবাই মিলে আলোচনা করে প্রশ্ন বানাতে বসে যাওয়া আর তার উত্তর খুঁজে বার করা এক সুন্দর শেখার উপায়। বই পড়ার অভ্যাসও খানিকটা ফিরিয়ে আনা যেতে পারে এভাবেই।

যাকিছু প্রশ্নই দেওয়া হোক না কেন, তার জন্য তো মুখস্থ উত্তর রেডি অথবা চ্যাটজিপিটি-এর মতো কোনো AI অ্যাপ দিয়ে বার করে ফেলা যেতে পারে। তাহলে? অন্তত প্রশ্ন করা চালু থাক। প্রশ্ন করে করে AI-এর লিমিটটা খানিকটা হলেও বুঝে নেওয়া যাক। উত্তর পড়ে বুঝে নিয়ে আবার প্রশ্ন করা যাক। মন্দ কি? প্রশ্ন করে করেই তো এগোনো যেতে পারে।

সেদিন, একজন অধ্যাপক AI-এর উপর একটা অনলাইন সেমিনার দিতে গিয়ে বলছিলেন, এখন এমন অবস্থা যে, স্টুডেন্টরা চ্যাট জিপিটি দিয়ে প্রজেক্ট থিসিস বা প্রশ্নের উত্তর লিখে ফেলছে। ধরা মুশকিল! তাহলে উপায় কী? টেকনোলজি তো হাতে আসবেই, তাকে তো থামিয়ে রাখা যাবে না। এক্ষেত্রে, এমন প্রশ্ন করো যা AI app সঠিক উত্তর দিতে পারবে না, কেননা সেখানে হয়ত থাকবে যুক্তি তৈরি করা অথবা নীতি ও জীবনদর্শনের কোন ব্যাপার। গভীর কারণ খুঁজতে যাওয়া এবং যুক্তি চিন্তার ধারা ও দর্শন এবং বোধ, এখানে এই আমরা মানুষেরা কিন্তু স্বতন্ত্র। এখন প্রশ্ন হল, এভাবেই কি আমরা AI-এর এলগোরিদমের অমোঘ পারদর্শিতার বিপরীতে স্বতন্ত্র একটা অস্তিত্ব, একটা আলাদা ভূমিকা বজায় রাখতে পারব?

আসলে, AI হল কম্পিউটার এলগোরিদম। এর সাফল্যের মূলে রয়েছে সুবিশাল তথ্যসম্ভার আর কম্পিউটার পাওয়ার। আদতে কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্ক হলেও তা বায়োলজিকাল ব্রেইন-এর থেকে অনেকটাই আলাদা। তবু, মানুষ যেসমস্ত কাজে পারদর্শী তা অনেকগুণ দক্ষতার সাথে করে ফেলছে এই কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্ক। মেশিন যেন বুদ্ধি খাটিয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, খুঁজে বার করছে সেইসব প্যাটার্ন যা একজন এক্সপার্ট মানুষেরও চোখে পড়ছে না। বেসিক কিছু ইনপুট নিয়ে AI ছবি আঁকছে, ফটোগ্রাফারদের থেকেও ভালো ছবি তৈরি করছে, গল্প-প্রবন্ধ লিখছে, সিনেমার স্ক্রিপ্ট তৈরি করছে, গান বানাচ্ছে। সিনেমা বানানোও শুরু হয়ে গেছে। এদিকে রোবট দিয়ে মানুষের অসাধ্য নানান কায়িক পরিশ্রম করানো অথবা চালকহীন গাড়ি চালানো – এসব নিয়ে তো টেকনোলজির উন্নতি হচ্ছেই। তাহলে, প্রশ্ন করতে হবে, আগামী দিনে আমাদের করার কী আছে? আমরা কি AI কে কাজে লাগিয়ে আরো নতুন কিছু উদ্ভাবন করতে পারি, উন্নততর সমাজ গড়তে পারি? আমরা কি প্রকৃতিকে, এই মহাবিশ্বকে বুঝতে AI-এর সাহায্য নিতে পারি?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

18 − 8 =