
আমরা বরাবরই ভেবে এসেছি আমাদের প্রাচীন প্রাইমেট পূর্বপুরুষরা ঘন সবুজ গ্রীষ্মমন্ডলীয় জঙ্গলে বসবাস করত। কিন্তু সাম্প্রতিক এক গবেষণা এই প্রচলিত ধারণা পুরোপুরি বদলে দিয়েছে। গবেষকদের মতে, প্রাইমেটদের উৎপত্তি ঘটেছিল আসলে শীতল ও শুষ্ক পরিবেশে, গ্রীষ্মমন্ডলে একেবারেই নয়।
গবেষণাটি পরিচালনা করেছেন ইউনিভার্সিটি অব রিডিং-এর জর্জে আভারিয়া-লাউত্রেও এবং তাঁর সহকর্মীরা। তাঁরা প্রাচীন প্রাইমেট জীবাশ্মের চারপাশের পরাগরেণু বিশ্লেষণ করে সেই সময়কার জলবায়ু নির্ধারণ করেন। দেখা যায়, প্রায় ৫৬ মিলিয়ন বছর আগে প্রাইমেটরা প্রথম আবির্ভূত হয়েছিল উত্তর আমেরিকায়। সেই সময়কার আবহাওয়া ছিল বেশ শীতল ও শুষ্ক যেখানে টিকে থাকা ছিল সত্যিই কঠিন। পরবর্তীতে তারা ইউরোপ ও চীনে ছড়িয়ে পড়ে। অর্থাৎ, প্রাইমেটদের জীবনের যাত্রা শুরু হয়েছিল প্রতিকূল আবহাওয়ায়, যা তাদের বিবর্তনকে আরও দৃঢ় করেছিল।
সেই প্রথম যুগের প্রাচীনতম পরিচিত প্রাইমেটদের মধ্যে অন্যতম ছিল টেইলহার্ডিনা, এক ক্ষুদ্র বৃক্ষচারী প্রাণী। এদের ওজন মাত্র ২৮ গ্রাম- আজকের মাউস লেমুরের সমান। এর নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য ছিল নখ, যা দিয়ে এ ডাল আঁকড়ে ধরতে পারত, ফল সংগ্রহ করত, এমনকি কীটপতঙ্গও শিকার করত। এই দক্ষতাই তাকে টিকে থাকতে সাহায্য করেছিল।
আজকের দৃষ্টিতে বিস্ময়কর হলেও, প্রাচীন প্রাইমেটরা সুমেরু অঞ্চলেও বসতি গড়েছিল। দীর্ঘ শীতকালীন খাদ্যসংকট দেখা দিলে তারা বিশেষ কৌশল অবলম্বন করত। যেমন খাদ্যের বিপাকক্রিয়া ধীর করে দেওয়া বা কখনও শীতঘুমে চলে যাওয়া। যেমনটা আজকের মাউস লেমুর বা ডোয়ার্ফ লেমুররা করে থাকে। এভাবে কঠিন পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে টিকে থাকা প্রজাতিগুলিই সময়ের সাথে বিবর্তিত হয়ে টিকে গেছে, আর যারা অচল ছিল তারা কালের অতলে তলিয়ে যায়।
যা বোঝা গেল প্রাইমেটদের টিকে থাকার ইতিহাস প্রমাণ করে যে জলবায়ু পরিবর্তন তাদের বিবর্তনের মূল চালিকা শক্তি ছিল। আজকের দিনে অরণ্যচ্ছেদন, আবাসস্থল ধ্বংস এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাইমেটরা আবারও সংকটে। ছোট ছোট বিচ্ছিন্ন এলাকায় সীমিত হয়ে যাওয়ায় তাদের জিন বৈচিত্র্য কমছে, ফলে পরিবর্তিত পরিবেশে খাপ খাওয়ানো কঠিন হয়ে পড়ছে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, এখনই উদ্যোগ না নিলে আমাদের এই ঘনিষ্ঠ আত্মীয়রা ভয়াবহ সংকটে পড়বে। প্রাইমেট রক্ষায় শুধু বৈজ্ঞানিক জ্ঞানই যথেষ্ট নয়, দরকার রাজনৈতিক পদক্ষেপ ও ব্যক্তিগত আচরণের পরিবর্তন। বিশেষ করে বুশমিট শিকার কমানো, বন সংরক্ষণ, ও জলবায়ু পরিবর্তন রোধে উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। আসলে প্রাইমেটদের সমস্যা তো আমাদের নিজেরও সমস্যা। যদি তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়, তবে মানবজাতিও নিরাপদ থাকবে না ।
এই গবেষণাটি থেকে পাওয়া একটি মূল্যবান শিক্ষা হল আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল প্রতিকূলতার ভেতর দিয়েই।পুর্বপুরুষদের অভিযোজনের ফল আমাদের বর্তমান অস্তিত্ব। ঠিক তেমনই আধুনিক মানব প্রজাতিকে টিকে থাকতে হলেও পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিয়ে অভিযোজিত হতে হবে, নচেৎ হারিয়ে যেতে হবে।
সূত্র: “The radiation and geographic expansion of primates through diverse climates” by Jorge Avaria-Llautureo, Thomas A. Püschel, Andrew Meade, Joanna Baker, Samuel L. Nicholson and Chris Venditti, 5 August 2025, Proceedings of the National Academy of Sciences.
DOI: 10.1073/pnas.2423833122