প্রাচীন জীবাশ্মের কারুকথা

প্রাচীন জীবাশ্মের কারুকথা

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২০ জুন, ২০২৫

দক্ষিণ আফ্রিকার কারু অঞ্চল। দেড় লক্ষ বর্গমাইল জুড়ে এক রহস্যময় নিঃসঙ্গতা। এখানে মাটির নীচে লুকিয়ে আছে এমন প্রাচীন ইতিহাস, যা ডাইনোসরেরও পূর্বযুগের গল্প বলে। এই পাথুরে ভূমিতে হাঁটলেই মনে হয়, যেন কোনো বিশাল বইয়ের পাতা উল্টে যাচ্ছে আর তার প্রতিটা স্তরই একেকটা যুগের জীবাশ্মীভূত অধ্যায়।এই ভূখণ্ডের জৈব খ্যাতি মূলত টিকে আছে ‘ডাইসাইনোডন্ট’ নামক কিম্ভুতকিমাকার এক প্রাণীর উপর। শূকর আকৃতির এই গাছখেকো প্রাণীটির ঠোঁট আর নিচের দিকে বাঁকানো দুটি দাঁত ছিল। ২৫ কোটিরও বেশি বছর আগে, যখন ডাইনোসরাও জন্মায়নি, তখন এরা কারুর রাজা ছিল। কারুর পাহাড়ের গা থেকে বেরিয়ে হঠাৎ বেরিয়ে এসেছে এদের খুলি । খুলির হাড় একদম সাদা, চোখে পরে দূর থেকেই। কিন্তু কারুর গল্প কেবল হাড় বা ভূতাত্ত্বিক মানচিত্রের নয়। ‘সান’ নামক জনগোষ্ঠীর তুলি আর বিশ্বাসেও গাঁথা। সানরা বসত গেড়েছিল জলাশয়ের পাশে, চুনাপাথরের গায়ে। তারা আঁকত শিকারের দৃশ্য, আর বিশ্বাস করত একরকমের সাপ-আত্মায়, যারা মেঘ ও বজ্রঝড় ডেকে আনে। ১৮৩৫ সালে, তাদের আঁকা একটি বিশেষ গুহাচিত্র ‘শিংওয়ালা সর্প ফলক’ শিংওয়ালা সাপ-গবেষকদের কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল। তাদের আঁকা সরু কুমিরের মতো প্রাণীটির নীচের দিকে রয়েছে এমন বাঁকা দাঁত। আফ্রিকায় এমন আর একটিও জীব মেলেনি। অনেকে একেই ‘বৃষ্টির দেবতা’ ভাবেন। কিন্তু প্যালিওনটোলজিস্ট জুলিয়ান বেনোয়া সেই আঁকায় খুঁজে পান অদ্ভুত এক মিল। টা হল, ডাইসাইনোডন্টের মাথার গঠন, দাঁতের কোণ এবং শরীরের অনুপাত! হুবহু মিলে যাচ্ছে! “এই চিত্রটি ১৮৩৫ সালের আগেই আঁকা, অর্থাৎ প্রথম ডাইসাইনোডন্ট বৈজ্ঞানিকভাবে চিহ্নিত হওয়ার (১৮৪৫ সালে) এক দশক আগেই। এটি প্রমাণ করে, দক্ষিণ আফ্রিকার আদিম বাসিন্দারা শুধু যে হাড় খুঁজে পেয়েছিল তাই না, বরং সেগুলোকে বিশ্লেষণ করে নিজেদের বিশ্বাস ও শিল্পের রূপ দিয়েছিল”, বলছেন বেনোয়া। সানদের আশেপাশের খননস্থল থেকে পাওয়া গেছে প্রাচীন পাথরের হাতিয়ার। বহুদূর থেকে আনা জীবাশ্ম দেখে মনে হয়, এগুলি তারা কৌতূহলবশে বা ধর্মীয় কারণে সংগ্রহ করত। ১৮০০ শতকের শেষভাগের মৌখিক কাহিনিতেও এমন বিশাল প্রাণীর উল্লেখ রয়েছে, যারা ‘মাটি শুকিয়ে যাওয়ার আগে’ পৃথিবী জুড়ে ঘুরে বেড়াত। আজকের বিজ্ঞান এই শিল্পকে নতুন চোখে দেখে। এই আঁকা কেবল গল্প নয়, এটি হতে পারে ইতিহাসের প্রাচীনতম ‘প্যালিও-ডকুমেন্টেশন’। এখানে শিল্পীই যেন জীবাশ্মবিদ। আর এই উপলব্ধিই কারুর ইতিহাস শুধু নয়, পালটে দেয় তার জীবাশ্ম চর্চার কেন্দ্রবিন্দুও।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

fifteen + seven =