ক্যালিফোর্ণিয়া কনডরস। এক বিশেষ ধরণের শকুনি। ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে এই বিশেষ প্রজাতির পাখিদের নিয়ে গবেষণা চলছে। প্রজননের মাধ্যমে কীভাবে এদের বংশবৃদ্ধি হচ্ছে সেই নিয়ে খুঁটিয়ে খুটিয়ে গবেষণা করছেন প্রাণীবিজ্ঞানীরা। কোন কনডর কার সঙ্গে প্রজননে মিলিত হচ্ছে, কোন পাখির কতগুলি সন্তানসন্ততি হচ্ছে, কাদের সন্তানদের জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে-সমস্ত গবেষণার সরকারি হিসেব রাখার জন্য একটি খাতা তৈরি করা হয়েছে। তার নাম ক্যালিফোর্ণিয়া কনডর স্টাডবুক।
১৯৮৩ সালে ২২টি এই পাখিকে নিয়ে গবেষণা শুরু হয়েছিল। কিন্তু কয়েক বছর আগে, বিজ্ঞানীরা তাদের রুটিন রিসার্চে ৯০০-র বেশি এই বিশেষ প্রজাতির পাখিদের ডিএনএ পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখেন দু’টি পাখি পিতৃত্বহীন! সম্পূর্ণভাবে পিতৃত্বহীন। তাদের কোনও বাবা নেই। স্টাডবুকে লেখা তাদের নাম এসবি-২৬০ আর এসবি-৫১৭। এই দুই পাখির ডিএনএ-র ১০০ শতাংশই এসেছে তাদের মায়েদের কাছ থেকে। সান দিয়েগোর বন্যপ্রাণীদের চিড়িয়াখানার সঙ্গে যুক্ত একজন জিনতত্ববিদ অলিভার রাইডার। বিস্মিত হয়ে তার মন্তব্য ছিল, “এই অপ্রত্যাশিত পর্যবেক্ষণ এবং তথ্যের কোনও জবাব আমার কাছে সেই মুহুর্তে ছিল না।” একটাই বিশ্লেষণ সেই সময় বিজ্ঞানীরা এবং জিনতত্ববিদরা করতে পেরেছিলেন। সেটা হল ওই দুই পাখির মায়েরা (কনডরস) নিজেদের সন্তানসম্ভবা করেছে কোনও শুক্রাণুর সহায়তা ছাড়াই! তার মানে পাখি দু’টো ‘ভার্জিন বার্থ’ দিয়েছে! কিন্তু রাইডারের মত বিজ্ঞানীরা আবার বলছেন, ২৬০ আর ৫১৭-র যে মা পাখিরা, তারা কিন্তু টেকনিক্যালি কুমারী নয়! কারণ তারা আগেও স্বাভাবিকভাবে যে পুরুষ কনডরদের সঙ্গে থাকত তাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে ছানার (সন্তান) জন্ম দিয়েছে।
এই ‘ভার্জিন বার্থের’ বৈজ্ঞানিক নাম পার্থেনোজেনেসিস। বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন শুধু বিশেষ প্রজাতির শকুনি পাখি নয়, মুরগি, টার্কির মত অন্য পাখিদের মধ্যেও দেখা গিয়েছে ভার্জিন বার্থ দেওয়ার প্রবণতা। এমনকী, সাপ, হাঙ্গর, টিকটিকি এবং বনি মাছের ক্ষেত্রেও এই লক্ষণ দেখা গিয়েছে। বিজ্ঞানীরা ধারাবাহিকভাবে এই পর্যবেক্ষণের পর এখন বলছেন যে পাখির ‘সিঙ্গল মাদার’ হওয়াটা এত বছর ধরে তারা ভাবতেন যে ব্যতিক্রমী ঘটনা, তা নয়।
দূর্ভাগ্যজনকভাবে, ওই দু’টি শকুনি পাখিকে ‘জেনেটিক্যালি ব্যতিক্রমী’ বলতে গেলে আরও যে যে পরীক্ষা করার দরকার ছিল সেটা বিজ্ঞানীরা করতে পারেননি। পাখি দু’টি মারা যায়। রাইডার জানিয়েছেন, বেঁচে থাকার সময় ওই পাখি দু’টির আচরণে এরকম কোনও বিশেষত্ব দেখা যায় নি যাতে মনে হয় তারা বাকি শকুনিদের তুলনায় আলাদা। যদিও দু’টি পাখিই শারীরিকভাবে অসুস্থ ছিল। এসবি-২৬০ এবং এসবি-৫১৭, দু’টি পাখিই পুরুষ। ২৬০ নম্বর পাখিটি ২০০১-এ সান দিয়েগো চিড়িয়াখানায় জন্ম নিয়েছিল। কিন্তু জঙ্গলে ছাড়ার দু’বছরের মধ্যে মারা যায়। আকারে খুব ছোট ছিল ২৬০ নম্বর পাখিটি। বিজ্ঞানীদের মনে হয়েছিল, বন্য পাখিদের সঙ্গে যুঝতে না পেরেই ও মারা যায়। এসবি-৫১৭ নম্বর পাখিটির জন্ম হয়েছিল ২০০৯-এ লস অ্যাঞ্জেলসের চিড়িয়াখানায়। ওই পাখিটির হাঁটতে কষ্ট হত কারণ ওর মেরুদণ্ডটি ব্যাঁকা ছিল। ওকে চিড়িয়াখানা থেকে ছাড়াই হয়নি। বন্দীদশা অবস্থায়ই ওই পাখিও মারা যায়। তখন ওর বয়স মাত্র আট বছর! ক্যালিফোর্ণিয়া কনডরসের আয়ু থাকে কয়েক দশক পর্যন্ত!
শেষ পর্যন্ত ২৬০ আর ৫১৭ নম্বরের দুই বিরল শকুনি পাখির ‘সিঙ্গল মাদারদের’ পার্থেজেনেসিস রহস্য উন্মোচন করতে পারেননি বিজ্ঞানীরা। তবে অন্যান্য কিছু প্রাণীদের মধ্যেও পার্থেজেনেসিসের লক্ষণ দেখেছেন তারা। টার্কি এবং সাপদের মধ্যেও পার্থেজেনেসিস প্রক্রিয়ার লক্ষণ দেখা গিয়েছে এবং তাদের মধ্যেও ভার্জিন বার্থ দেওয়ার প্রবণতা দেখা গিয়েছে, জানিয়েছেন মিসিসিপি রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের এক পোল্ট্রি বিজ্ঞানী রেশমা রামাচন্দ্রন এবং তুলসা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর এক জীববিজ্ঞানী ওয়ারেন বুথ। বুথ নির্দিষ্টভাবে জানিয়েছেন, একটি সাপের কঙ্কালে হাড়ের যে পরিবর্তন তার সঙ্গে এসবি-৫১৭ কনডরের হাড়ের পরিবর্তনের অনেক মিল রয়েছে। যদিও বুথ কনডর গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। পার্থেজেনেসিস নিয়ে একাধিক গবেষণার পর বিজ্ঞানীরা বলছেন একটা কোষ ভেঙে দু’ভাগে বিভক্ত হওয়ার পর একটা কোষ দিয়ে ডিমের কোষ তৈরি হয়। অন্য কোষটা একটা পোলার বডিতে রূপান্তরিত হয় যার মধ্যে তৈরি হয় ডিএনএ। স্বাভাবিকভাবে পোলার বডি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, কিন্তু পাখিদের ক্ষেত্রে গবেষনা জানাচ্ছে পোলার বডি সেই ডিম্বকোষের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে কোনওভাবে সৃষ্টি করে শুক্রাণুর। তবে এর ব্যতিক্রমও রয়েছে। সব মহিলা পাখি পার্থেজেনেসিস প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যায় না। তার একাধিক গুরুত্বপূর্ণ কারণও রয়েছে। রেশমা রামাচন্দ্রন যেমন বলছেন, জিনের প্রকারভেদ একটা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বিশেষভাবে টার্কি আর মুরগির ক্ষেত্রে। তারপর পরিবেশগত, বিশেষত তাপমাত্রা আরও একটা প্রভাব সৃষ্টিকারী উপাদান।
তবে কনডর নিয়ে হাল ছাড়ছেন না বিজ্ঞানীরা! ওই দুই বিরল প্রজাতির পাখিদের জিন নিয়ে গবেষণা করবেন তারা। এবং সেখানে অন্তত আরও একশোটি ওই প্রজাতির পাখিও আসবে তাদের গবেষণায়। রাইডার জানিয়েছেন, কনডরদের প্রজনন প্রক্রিয়া নিয়ে তিনি ও তার দল পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে গবেষণা করবে, পাখিদের জিন, তাদের মিউটেশন, সমস্তটা জানার পরই ‘ভার্জিন বার্থ’ সম্পর্কে বিশদে জানা যাবে। কিন্তু কনডরের সংখ্যা যে খুব কম! মাত্র ৫০০টি! অন্যান্য বিপজ্জনক প্রাণীদের সঙ্গে সে-ও ইতিমধ্যে তালিকাভূক্ত! তাই তাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যও রাইডারের মত বিজ্ঞানীরা উঠে পড়ে লেগেছেন বিশেষ প্রজাতির শকুনদের প্রজনন প্রক্রিয়া সম্পর্কে পুরোটা জানার জন্য।