খাবারে থাকা এক পরিচিত অ্যামিনো অ্যাসিড প্রোলিন সম্ভবত আমাদের মনের গভীরে কাজ করে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় স্পেনের গিরোনা বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট (আইডিবিজিআই) ও বার্সেলোনার পম্পেউ ফাব্রা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইউপিএফ) বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, প্রোলিন নামের এই উপাদানটির সঙ্গে ডিপ্রেশনের যোগসূত্র রয়েছে। আমরা কী খাচ্ছি, আমাদের অন্ত্রের জীবাণুর গঠন কেমন, এবং মস্তিষ্কে পুষ্টি উপাদান পরিবহনের রাস্তা কেমন কাজ করে- এই তিন উপাদান একত্রে মনের স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলতে পারে। প্রোলিন একটি সাধারণ অ্যামিনো অ্যাসিড। অর্থাৎ প্রোটিন গঠনের ক্ষুদ্র উপাদান। এটি মাংস, মাছ, ডিম, দুধ, এমনকি জেলাটিনেও প্রচুর থাকে।
শতাধিক অংশগ্রহণকারীর খাদ্যাভ্যাস বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, যাঁদের খাদ্যে প্রোলিনের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে বেশি, তাঁদের মধ্যে অবসাদ বা হতাশার প্রবণতাও বেশি দেখা যায়। শুধু খাদ্যতালিকাই নয়, এদের রক্তে প্রোলিনের পরিমাণও পরিমাপ করা হয়। ফলাফল আরও পরিষ্কার। যাঁদের রক্তে প্রোলিনের ঘনত্ব বেশি, তাঁদের মানসিক অবসাদের মাত্রাও বেশি। অর্থাৎ, এই অ্যামিনো অ্যাসিডটির মাত্রা যত বাড়ে, মনের ভারও তত বাড়ে। কিন্তু সব মানুষ একইভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায় না। এখানেই আসে অন্ত্রের জীবাণুসমষ্টি বা মাইক্রোবায়োমের ভূমিকার কথা। কিছু মানুষের অন্ত্রের জীবাণু প্রোলিনকে ভাঙতে এবং সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে। তাঁদের রক্তে প্রোলিন জমে না, ফলে মানসিক অবসাদও দেখা যায় না। অন্যদিকে, যাঁদের অন্ত্রের জীবাণুরা প্রোলিন নিয়ন্ত্রণে দুর্বল, তাঁদের শরীরে এই অ্যামিনো অ্যাসিড বেশি মাত্রায় জমে এবং তার সঙ্গেই দেখা দেয় মনমরা ভাব। এই পর্যবেক্ষণের পর বিজ্ঞানীরা যাদের প্রোলিন নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দুর্বল তাদের মাইক্রোবায়োম, অর্থাৎ অন্ত্রের জীবাণুসমষ্টি , ইঁদুরের শরীরে প্রতিস্থাপন করেন। আশ্চর্যের বিষয়, এই ইঁদুরগুলোও মানুষের মতোই “অবসন্নতা সদৃশ” আচরণ করতে শুরু করে। অর্থাৎ অন্ত্রের জীবাণুর প্রকৃতি মস্তিষ্কের আবেগে সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে।
এরপর বিজ্ঞানীরা মস্তিষ্কে প্রোলিন পরিবহনের জন্য দায়ী জিন ঘটিত দিকটির উপর নজর দেন। তাঁরা দেখেন, কিছু মানুষের প্রোলিন পরিবহনের গতি বা ক্ষমতা ভিন্ন। এই ভিন্নতা মস্তিষ্কে প্রোলিনের জমাট বাঁধা ও স্নায়বিক যোগাযোগে পার্থক্য ঘটাতে পারে, মনোভাব নিয়ন্ত্রণে যার ভূমিকা আছে। গবেষণার পরবর্তী ধাপ ছিল ফলমাছি বা ড্রোসোফিলা-র ওপর পরীক্ষা। মূলত ল্যাকটোব্যাসিলাস ও এন্টারোব্যাক্টার, এই দুটি ব্যাকটেরিয়া প্রোলিন ভাঙার প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ল্যাকটোব্যাসিলাস সমৃদ্ধ খাদ্য খাওয়ালে ফলমাছিরা তুলনামূলকভাবে সক্রিয় ও স্থিতিশীল থাকে, কিন্তু এন্টারোব্যাক্টার-যুক্ত খাদ্য পেলে তাদের আচরণে হতাশা জাতীয় লক্ষণ দেখা যায়।বিজ্ঞানীরা জিন-সম্পাদনার মাধ্যমে এমন ফলমাছিও তৈরি করেন যাদের মস্তিষ্কে প্রোলিন প্রবেশের রাস্তা একেবারে বন্ধ।ফলাফল? এই মাছিগুলোতে অবসাদের লক্ষণ প্রায় অনুপস্থিত। তাই মস্তিষ্কে প্রোলিন প্রবেশই হতে পারে মানসিক অবসাদের এক গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক।
এই আবিষ্কার এক নতুন দিগন্ত খুলে দিচ্ছে। যদি প্রোলিনের বিপাক বা মস্তিষ্কে তার পরিবহনের পথ নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তাহলে হয়তো ডিপ্রেশনের চিকিৎসায় এক নতুন দিশা মিলবে। তবে মানুষের ক্ষেত্রে প্রোলিনের সুনির্দিষ্ট মাত্রা বা তার মানসিক প্রভাব সম্পর্কে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়নি।পাশাপাশি,অন্ত্রের জীবাণুগুলির গঠন, জিন বৈশিষ্ট্য ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের পারস্পরিক সম্পর্ক— এ সবকিছুই আরও বিস্তারিতভাবে বুঝে নিতে হবে। এই মুহূর্তে কোনো চিকিৎসা সংস্থা বা পুষ্টিবিদ প্রোলিন কমিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন না। বরং গবেষকরা বলছেন, মানসিক স্বাস্থ্য ও খাদ্যের সম্পর্ক এতটাই জটিল যে সেটিকে কোনো সরল সমীকরণে ফেলা যায় না।
সূত্র : “Microbiota alterations in proline metabolism impact depression” by Jordi Mayneris-Perxachs, et.el; 3 May 2022, Cell Metabolism.
