
যে খবর সত্যি নয় তা গুজব, অথবা রটনা, অথবা কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে বানানো মিথ্যা খবর হতে পারে। আর, মিথ্যা কোনকিছু খবরের মতো করে পরিবেশন করলে বা বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার চেষ্টা করা হলে তাকে বলা যাবে ফেক নিউজ (fake news)! এই ‘ফেক নিউজ’ কথাটা ইদানীং বেশ চালু হলেও তা নতুন কিছু নয়। শুধু বুঝে নিতে হবে, ফেক নিউজের নানান ধরণ আছে। ইংরেজিতে অনেক শব্দ আছে এসবের জন্য যেমন, misinformation, disinformation, infodemic এরকম কিছু শব্দ। প্রথম দুটো হলো অনিচ্ছাকৃত ভুল আর ইচ্ছাকৃত ভুল। এসবের মধ্যে ‘infodemic’ কথাটা অবশ্য অপেক্ষাকৃত নতুন। কথাটা ব্যবহার করা হয় যখন কোনো ভুল ইনফরমেশান বা ফেক নিউজ ভাইরাল হয়ে যায়, তার মানে, ভাইরাসের মতো দ্রুত ছড়িয়ে যায় সমাজে, যেমনটা হয়েছিলো কোভিদ-এর সময়। ভাইরাস ও এপিডেমিক বিষয়ক নানান বক্তব্য এবং অসমর্থিত তথ্য মুহুর্তে ছড়িয়ে পড়তো সেসময় স্যোসাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে।
এখন স্যোসাল মিডিয়ার যুগে ফেক নিউজের বেশ বাড়বাড়ন্ত। খুব সহজেই মানুষ ঘরে বসে কিছু খবর তৈরি করে ফেলছে, যার যা মনে হচ্ছে লোকজন লিখে ফেলছে সেসব আর কিছু লোক তা অবলীলায় ছড়িয়ে দিচ্ছে স্যোসাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে। প্রশ্ন হলো, ফেক নিউজ লোকে বানায় কেন? আসলে, বানিয়ে বানিয়ে কিছু লিখে দেওয়াটা খুব সহজ একটা কাজ, তা যেমনই হোক। এরজন্য ভাবনাচিন্তা আর বিশেষ পরিশ্রম করতে হয় না। অন্যদিকে, কোনো সত্য খুঁজে বার করাটা অনেক পরিশ্রমসাধ্য ব্যাপার। বিশেষ কোনো সিদ্ধান্তে আসতে গেলে অথবা সত্যের দোড়গোড়ায় পৌঁছতে চাইলে অনেক পরিশ্রম করতে হয়। বিজ্ঞান গবেষক, অনুসন্ধানী সাংবাদিক বা গোয়ান্দাদের ক্ষেত্রে যেমনটা হয়। কিন্তু, পরিশ্রম না করেই অনেক মানুষ খবরের মালিকানা পেতে চায়!
কথাটা হলো, ফেক নিউজ বুঝব কী করে? যা শুনব, যা পড়ব তাই কি বিশ্বাস করব নাকি কোনভাবে একটু যাচাই করে নেব? এবিষয়ে একটু সচেতনতা ও বিজ্ঞানমনস্কতা আমাদের সাহায্য করতে পারে। বিজ্ঞান পড়তে গিয়ে অথবা বিজ্ঞানবিষয়ক কাজ করতে গিয়ে আমরা যেমন প্রশ্ন করতে থাকি, অনুসন্ধিৎসা থেকে বিষয়টা বোঝার জন্য নানাভাবে অনুসন্ধান চালাই, হাতে পাওয়া কিছু তথ্যকে যুক্তি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করি, তারপর তাদের মধ্যে একটা লজিক্যাল কানেকশান তৈরি করি, অনেকটা সেভাবেই কোনো নিউজকে দেখার চেষ্টা করলে তা ফেক নিউজ কিনা অনেক ক্ষেত্রেই বুঝে নেওয়া সম্ভব।
প্রথম কথা হলো, খবর বা নিউজ-এর উৎস কী সেটা দেখতে হবে। যে লেখাটা পড়ছি অথবা যা কানে শুনছি তার সূত্র ধরে একটু খুঁটিয়ে কিছু পারিপার্শ্বিক বিষয় বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করা যেতে পারে। লেখার প্রাথমিক সূত্র, তা অথেনটিক কিনা সেসব চেক করা যেতে পারে। লেখাটা কে লিখছেন, বা কে বলছেন, তার বিশ্বাসযোগ্যতা কতটা সেসব একটু চেষ্টা করলেই বার করে ফেলা যায়। লেখকের ঝোঁক কোনদিকে, তিনি বস্তুনিষ্ঠ হয়ে লিখছেন নাকি ব্যক্তিগত আবেগ থেকে লিখছেন, কী তাঁর উদ্দেশ্য, ইত্যাদি জেনে নেওয়ার চেষ্টা করা যেতে পারে। সবশেষে, কোনো বিষয়ে কিছু লেখা পেলে, তা না বুঝতে পারলে সেই বিষয়ের কোন এক্সপার্ট-এর কাছ থেকে কিছুটা জেনে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করা যেতে পারে। মোট কথা, একটু সময় দিতে হবে, দায়িত্ববান হতে হবে। কোনো দৃষ্টিআকর্ষক খবর পাওয়ামাত্রই তা ছড়িয়ে দেওয়ার আগে একটু ভাবনাচিন্তা করলে ফেক নিউজের বিস্তার অনেকটাই কমানো সম্ভব।
বিজ্ঞান বিষয়ক কোনো খবর হলে সেটা আজগুবি কিনা তাও এভাবেই প্রাথমিকভাবে খতিয়ে দেখা যেতে পারে। তবে, তার জন্য কিছুটা প্রাথমিক জ্ঞান বা পড়াশুনা আমাদের সহায় হতে পারে। যেমন, আমেরিকার মতো উন্নত দেশে এখনো প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ পৃথিবীর আকার গোল না ভেবে চ্যাপটা (flat earth) তল মনে করেন। এর কারণ কি? কিছু লোক হয়ত কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে এসব প্রচার চালান, নিশ্চয়ই কিছু যুক্তিও দেন তাঁরা, কিন্তু, দৃশ্যমান জগতের অভিজ্ঞতা এবং বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ সহ অনুধাবন করলেই সেসব বিরুদ্ধ যুক্তির ফাঁক বোঝা যাবে।
দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, আমাদের সমাজে মারাত্মক কোনো ঘটনা ঘটলে অথবা কোনো উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হলে বড় মিডিয়াগুলো তাদের সুবিধামতো একটা ন্যারেটিভ বা ভাষ্য তৈরি করে দেয়। এতে হয়ত তাদের টি আর পি বাড়ে, হয়ত কোনো দলের সুবিধা হয়, কোনো প্রোডাক্ট-এর বিক্রি বাড়ে। কিন্তু, বিষয়টা হলো, সাধারণ মানুষ যুক্তিতর্ক বিসর্জন দিয়ে আবেগে মথিত হয়ে একবার সেই ভাষ্য গ্রহণ করে ফেললে, পরে মনের মধ্যে গেঁথে যাওয়া ধারণা থেকে সে আর সরে আসতে পারে না, চিন্তা করার অনীহা তৈরি হয়। যুক্তি-চিন্তা দিয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো অনেক বেশি পরিশ্রমসাধ্য কাজ। আগে থেকে একটা ভাষ্য তৈরি থাকলে তা ধারণ করাটা অনেক সহজ। এসব ক্ষেত্রে যুক্তির থেকে আবেগ প্রাধান্য পায়।
বিজ্ঞান পড়ার ক্ষেত্রেও আমরা অনেকসময়েই এরকম কিছু করি যা বিজ্ঞানচর্চার পরিপন্থী। বিজ্ঞানের বই থেকে কিছু পড়লে দেখা যায়, তার আকর্ষণ বা বিবরণ আমাদেরকে প্রায়শই আবেগাপ্লুত করে, আমরা প্রশ্ন করতে ভুলে যাই। বিজ্ঞানের সত্যতা যাচাই করে, চিন্তাভাবনা করে আমরা সাধারণত বিষয়টার গভীরে যেতে চাই না। কিন্তু, এভাবে যেমম প্রকৃত বিজ্ঞান শিক্ষা হয় না, তেমনিই সমাজের অজস্র তথ্য বা খবর, তা সঠিক না বেঠিক যাচাই করার আগেই আমাদের মনে একটা বিশ্বাস জন্মে যায়।
২০১৬ সালে, অক্সফোর্ড ডিকশনারি ঘোষণা করেছিলো, সেবছরের চ্যাম্পিয়ান শব্দ, “Post- Truth”! সে আবার কী? দেখা যাচ্ছে, জনমত গঠনের ক্ষেত্রে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে যেখানে বস্তুনিষ্ঠ বা অবজেক্টিভ চিন্তাভাবনা প্রাধান্য না পেয়ে তার জায়গা দখল করে নিচ্ছে আবেগ এবং ব্যক্তিমানুষের বিশ্বাস। বিশ্বজুড়ে এই বছরটা দুটো ঘটনার ঘনঘটায় পরিপূর্ণ। ব্রিটেনের ব্রেক্সিট রেফারেন্ডাম এবং আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট ইলেকশান। আমরা সকলেই জানি, আবেগ ও বিশ্বাসের প্রাবল্য ডেকে নিয়ে এসেছিলো সর্বব্যাপী ফেক নিউজ এবং পোস্ট ট্রুথ-কে। তার প্রভাব পড়েছিলো ওইসব ঘটানাতে।
এরপর এসেছিলো বিশ্বজুড়ে Covid-19-এর অতিমারী। কতশত শিক্ষিত মানুষও আতঙ্কে, আবেগে, নানানরকম খবরে বিশ্বাস করতে থাকলেন। জীবন মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সেসব বিশ্বাস আরো গাঢ় রূপ নেয়। স্থানীয় সংবাদপত্রগুলো বহু জিনিস যাচাই বা অনুসন্ধান না করেই খবর তৈরি করতে থাকে আর মানুষ তা চটজলদি বিশ্বাস করতে থাকে। বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পড়েছিল মারাত্মকভাবে। সঠিকভাবে যাচাই না করেই, খানিকটা post-truth জমানার জনমত দিয়ে প্রভাবিত হয়েই যেন অনেক গবেষণাপত্র পত্র প্রকাশিত হচ্ছিলো সেসময়। তাদের অনেকগুলোই পরে প্রমাণের অভাবে তুলে নেওয়া হয়েছিল। যেমন, একটা বিষয় ছিলো, SARS-COV 2 ভাইরাস নাকি ল্যাবরেটরিতে তৈরি অথবা কোনো জৈব-অস্ত্র (bioweapon) তৈরির প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত। এবিষয়ে কিছু মানুষের ধারণা দৃঢ় হয়, কিছু গবেষণাপত্রও প্রকাশিত হতে থাকে এইরকম কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে। অনেক পরে দেখা যায়, এরকম একটা বিষয় কোনভাবেই প্রমাণ করা যায় নি। শেষে ওই সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্রগুলো তুলে নিতে বাধ্য হন তাদের লেখকরা।
মনে করা যাক, কেউ এসে বললো সে নির্জন কোন জায়গায় ব্যাটম্যান কিংবা ভূত দেখেছে। একটু আধটু বিজ্ঞানের চর্চা করলে, ডারউইনের থিওরি বিষয়ে জানলে আমাদের বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের একটা প্রাথমিক ধাপ তৈরি হয়। জীববিজ্ঞান বুঝে পড়লে কেউ এইসব আজগুবি বিশ্বাসের ফাঁদে পড়বে না, বরং চ্যালেঞ্জ করলে যাচাই করে দেখতে চাইবে। তবে, মুশকিল হলো, আমরা তথাকথিত শিক্ষিত মানুষেরাও খুব সহজেই অনেক কিছু বিশ্বাস করে ফেলি, হয়ত সহজে রোমাঞ্চিত হওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাই না।
কত সহজেই মানুষ বিশ্বাস করে ফ্যালে কতকিছু। এই তো কিছুদিন আগেই, একটা বলিউড সিনেমা দেখার পর কিছু মানুষ আবেগ ও বিশ্বাসের বশে একটা প্রাসাদের আশেপাশে মাটি খুঁড়ে সোনা বের করতে লেগে গেলো! সিনেমার গল্পতে নাকি সেরকমই কিছু বলা আছে। সিনেমা আর বাস্তবের মধ্যে তফাৎ হারিয়ে মানুষ কত কী সিদ্ধান্ত করে বসে। আর, এদেশে তো একটা বিরাট সংখ্যক মানুষ তাদের পছন্দের সিনেমা দেখে সিনেমার গল্পকেই প্রামাণ্য ইতিহাস বলে মনে করে। প্রচার, আবেগ ও ভক্তির দেশে পুরাণের গল্পকে তারা ইতিহাস বা বিজ্ঞানের ভিত্তি মনে করে, আজগুবি জিনিসের উপর তাদের বিশ্বাস দৃঢ় হয়। প্রমাণের তোয়াক্কা কেউ করে না, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে বিচার করে না।
১৯৩৮ সাল। রেডিও ব্রডকাস্টিং-এর ক্ষেত্রে একটা ধুন্দুমার কান্ড ঘটেছিলো আমেরিকায়। বিখ্যাত লেখক H.G. Wells-এর “War of the Worlds” রেডিওতে এমনভাবে পরিবেশিত হয়েছিলো যে কিছু শ্রোতা ভুল বুঝে গল্পের বিষয়, মঙ্গলগ্রহ থেকে প্রাণীদের পৃথিবীতে আগমন-কে সত্যি বলে ভেবে নিয়ে আতঙ্ক ছড়িয়েছিলো। এডগার এলান পো-এর নাম সবাই শুনেছে। সে অনেক কাল আগের কথা। ১৮৪৪ সাল। তিনি একটা গল্প বানিয়ে নিউইয়র্ক সান পত্রিকাতে দিলেন। একটা হট এয়ার বেলুনে করে মানুষ এটল্যান্টিক মহাসাগর পারি দিচ্ছে। বেশ বিশ্বাসযোগ্য করে খবরের মতো করে ছাপা হয়েছিলো সেটা। মানুষ বিচার বিবেচনা বা বিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষণ না করেই, সত্যি খবর ভেবে হৈ চৈ বাঁধালো বেশ কিছুকাল। পরে অবশ্য লেখক তাঁর লেখা তুলে নিতে বাধ্য হন। এসবকিছুই তখনকার দিনের ফেক নিউজ! যদিও এখনকার মতো পৃথিবী জুড়ে ভাইরাল হতো না সেসব। অবশ্য এই “fake news” শব্দবন্ধ জনপ্রিয় হয়েছে মাত্র বছর কয়েক আগে থেকে।
একটু পড়াশোনার চর্চা, একটু ভাবার অভ্যাস, একটু কষ্ট করে ইন্টারনেট বা অন্য সোর্স থেকে দেখে মিলিয়ে নিতে পারলে ফেক নিউজ-এর বাড়বাড়ন্ত অনেক কমতে পারে। ফেক নিউজ প্রতিরোধের উপায় হিসাবে আমাদের সচেতনতা বাড়াতে হবে, নইলে তা আমাদের সমাজ এবং আমাদের বিজ্ঞাননির্ভর সভ্যতার অগ্রগতির পক্ষে যে ভীষণ ক্ষতিকর হবে তা বলাই বাহুল্য।
খুব প্রয়োজনীয় প্রবন্ধ – সুন্দর সহজ উপস্থাপনা।