ফ্রাঙ্কলিন ডব্লিউ স্টাল-এর প্রয়াণ

ফ্রাঙ্কলিন ডব্লিউ স্টাল-এর প্রয়াণ

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১৯ জুলাই, ২০২৫

গত ২ এপ্রিল ৯৫ বছর বয়সে প্রয়াণ ঘটেছে ফ্রাঙ্কলিন ডব্লিউ স্টাল (১৯২৯-২০২৫)-এর। সহকর্মী ম্যাথিয়ু মেসেলসন (জন্ম ১৯৩০)-এর সঙ্গে ১৯৫৭-৫৮ সালে তিনি ডিএনএ গঠন নিয়ে যে-কাজ করেছিলেন তা আণবিক জীববিজ্ঞানে একটি দিক্‌চিহ্ণ হয়ে রয়েছে। তিনি ও তাঁর বন্ধু মেসেলসন দুজনে মিলে পাসাডেনার ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজিতে আশ্চর্য সুন্দর এক পরীক্ষা করেন। তা থেকে প্রমাণ হয় যে ডিএনএ-র ঘোরানো সিঁড়ির মতো প্যাঁচানো জোড়া হেলিক্স গড়নের আবিষ্কর্তা ফ্রান্সিস ক্রিক ও জেমস ওয়াটসন তাঁদের যুগান্তকারী গবেষণায় যে-তত্ত্বপ্রস্তাব পেশ করেছিলেন তা সত্য। কী বলেছিলেন ক্রিক আর ওয়াটসন? তাঁরা বলেছিলেন, ডিএনএ-র দুটি বেস যেভাবে পরস্পরের সঙ্গে জুড়ি বাঁধে, তা থেকে মনে হয় জিন-বস্তুর নকল তৈরি করার কোনো একটা প্রক্রিয়া নিশ্চয়ই আছে। পরে ক্রিক-ওয়াটসনের দুই তরুণ ছাত্র স্টাল আর মেসেলসন একটা অতি সরল কিন্তু অত্যন্ত জটিল ভাবনার পরিচয়বাহী পরীক্ষা করে প্রমাণ করলেন, ক্রিক-ওয়াটসনের অনুমান সত্যি। তারপর থেকে ডিএনএ-র জোড়া হেলিক্স গড়নের সত্যতা নিয়ে আর কোনোদিন কোনো প্রশ্ন ওঠেনি।
সেই সরল-জটিল পরীক্ষাটা ছিল এইরকম। ডিএনএ-র এক প্রধান উপাদান হল নাইট্রোজেন। দুই বন্ধু নাইট্রোজেনের দুটি রূপ নিয়ে পরীক্ষা করলেন : একটি ভারী (এন-১৫), অন্যটি হালকা (এন-১৪)। এবার তাঁরা ভারী নাইট্রোজেন সংবলিত একটি খাদ্য-উৎসে ই কোলাই ব্যকটেরিয়া ছেড়ে দিলেন। তারপর সেই ই কোলাই-কে হালকা নাইট্রোজনের মধ্যে সরিয়ে নিয়ে গেলেন। তারা সেখানে বংশবৃদ্ধি করতে লাগল। ই কোলাই-এর প্রতিটি প্রজন্ম থেকে তাঁরা ডি এন এ নিষ্কাশন করে সেটাকে একটা সেন্ট্রিফিউজে ভরে দিলেন। সেন্ট্রিফিউজের কাজ হল বনবন করে ঘুরতে ঘুরতে ভারী থেকে হালকা উপাদান আলাদা করা, অনেকটা দুধ থেকে ননী আলাদা করার মতন। এবার সেই আলাদা আলদা ডিএনএ-র ঘনত্ব মেপে তাঁরা প্রমাণ করে দিলেন যে ই কোলাই-এর বংশবৃদ্ধির প্রতিটি প্রজন্মে তারা নিজেদের কপি তৈরি করে এবং আদি প্রজন্মের ভারী সূত্রগুলি হালকা ‘কন্যা-প্রজন্মে’র সঙ্গে জুড়ি বাঁধে। ১৯৫৮ সালে এই পরীক্ষার ফল প্রকশিত হল। ক্রিক-ওয়াটসনের তত্ত্বানুমান সত্যি বলে প্রমাণিত হল।
স্টাল-এর বাবা ছিলেন নিউ ইংল্যান্ড-এর টেলিফোন সংস্থার যন্ত্র-বিশেষজ্ঞ। মা গৃহবধূ। স্টাল ডাক্তার হবার জন্য হার্ভার্ডে জীববিজ্ঞান পড়তেন। কিন্তু পড়ার পয়সা জোগাড়ের জন্য কাজ করতে হত, অনেক দূর থেকে যাতায়াত করতে হত। কাজেই যথেষ্ট ভালো ফল করতে পারলেন না, ডাক্তার হওয়া হল না। ১৯৫১-য় স্নাতক হয়ে ঠিক করলেন, হাইস্কুলে জীববিজ্ঞান পড়াবেন। কিন্তু মা বললেন, না তুই পড়া চালিয়ে যা। রচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু আর্থিক সুবিধা পেয়ে সেখানেই ভর্তি হলেন। সেখান থেকে তাঁর মাস্টারমশাই তাঁকে ১৯৫২ সালে পাঠালেন কোল্ড স্প্রিং হার্বার-এর ল্যাবরেটরিতে। সেখানে ব্যাকটেরিয়া-খাদক ব্যাকটেরিওফেজ নিয়ে গবেষণা করলেন। সেটাই তাঁর পথ খুলে দিল। তিনি উপলব্ধি করলেন, ভাইরাস আর ব্যাকটেরিয়ার অপেক্ষাকৃত সরল জিনোম নিয়ে কাজই হল জিনতত্ত্বের ভবিষ্যৎ বিকাশের পথ। এরপর তিনি মাসাচুসেট্‌স-এর মেরিন বায়োলজিক্যাল ল্যাবরেটরিতে খোদ ওয়াটসন আর ক্রিকের আণবিক জীববিজ্ঞান ক্লাসে নাম লেখালেন। আর সেখানেই তাঁর সঙ্গে প্রগাঢ় ঘনিষ্ঠতা হল ভবিষ্যতের অবিচ্ছেদ্য বন্ধু মেসেলসন-এর। ঘণ্টার পর ঘন্টা, দিনের পর দিন দু বন্ধুর মধ্যে চলল ডিএনএ-র কপি কীভাবে হয় তা বোঝবার জন্য উপযুক্ত পরীক্ষাপদ্ধতি নিয়ে আলোচনা। রচেস্টার-এ তাঁর পি-এইচ ডি হয়ে গেল ১৯৫৬ সালে। তারপরই তাঁরা ঘটালেন সেই দিগ্‌দর্শী পরীক্ষা, যার বর্ণনা আমরা ওপরে দিয়েছি। এই পথপ্রদর্শক পরীক্ষার সূত্র ধরে ঘটল আরও অনেক গবেষণা, যা জিনতত্ত্বকে সমৃদ্ধ করল।
এর পর ক্যালটেক ছেড়ে তিনি চলে এলেন ওরেগন বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে বেরোল জিনতত্ত্ব বিষয়ে তাঁর দুটি বিখ্যাত বই।
ডঃ স্টাল, ম্যাকআর্থার ফাউন্ডেশন-এর ‘জিনিয়াস গ্রান্ট’, গাগেনহাইম ফেলোশিপ এবং জীবনব্যাপী অবদানের জন্য জেনেটিক্‌স সোসাইটি অব আমেরিকার টমাস হান্ট মর্গ্যান পদক প্রভৃতি বহু সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন।

সূত্র : Washington Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

one + twenty =