
ফ্লুইড প্রবাহ একটি আকর্ষণীয় এবং জটিল ঘটনা যা বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক এবং প্রকৌশল ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে অন্তর্দৃষ্টি অর্জন, দক্ষ সিস্টেম ডিজাইন এবং বিভিন্ন ভৌত ও রাসায়ানিক আচরণের পূর্বাভাসের জন্য ফ্লুইড প্রবাহের বৈচিত্র্য বোঝা এবং কার্যকরভাবে বর্ণনা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফ্লুইড গতি বর্ণনা করার জন্য দুটি বিশিষ্ট পদ্ধতি হল ল্যাগ্রাঞ্জিয়ান এবং অয়লেরিয়ান বর্ণনা। এই নিবন্ধে, আমরা এই দুটি পদ্ধতির মধ্যে পার্থক্য, তাদের প্রয়োগ এবং তাদের মধ্যে গবেষণার সময় নির্বাচনের বিষয়গুলি অন্বেষণ করব।
ল্যাগ্রাঞ্জিয়ান এবং অয়লেরিয়ান বর্ণনায় প্রবেশ করার আগে, ফ্লুইড গতিবিদ্যা সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা থাকা অপরিহার্য। ফ্লুইড গতিবিদ্যা হল ফ্লুইড পদার্থ, যা তাদের পাত্রের আকৃতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ এবং প্রবাহিত হয়, তা বিভিন্ন পরিস্থিতিতে কীভাবে আচরণ করে তার অধ্যয়ন । বাতাসের গতি, নদীতে জলের প্রবাহ, অথবা আমাদের দেহে রক্তের আচরণ সবই ফ্লুইডের গতির মৌলিক নীতি এবং সমীকরণ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় ।
ফ্লুইড গতিবিদ্যার বিভিন্ন ধারণা নিয়ে রয়েছে ফ্লুইডের বৈশিষ্ট্য, প্রবাহ ব্যবস্থা এবং সংরক্ষণের সূত্রগুলো। আরও তলিয়ে ভাবলে এর মধ্যে রয়েছে বেগ, চাপ এবং ঘনত্বের মতো মৌলিক পরিমাণগুলি বোঝা এবং স্থানে ও সময়ে কীভাবে এগুলি পরিবর্তিত হয় তা বোঝা। গাণিতিক মডেল, সমীকরণ এবং গণনা কৌশল প্রয়োগ করে, আমরা উল্লেখযোগ্য নির্ভুলতার সাথে ফ্লুইডের আচরণ বিশ্লেষণ এবং ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারি। ফ্লুইড গতিবিদ্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হল সান্দ্রতা , যা ফ্লুইড পদার্থের প্রবাহ প্রতিরোধকে বোঝায়। অনেক সময় বিজ্ঞানীরা মজা করে সান্দ্রতাকে ভরবেগের পরিবর্তনের হারের ‘বার্তাবহ’ (মেসেঞ্জার) বলে থাকেন । সান্দ্রতা ফ্লুইড পদার্থের আচরণ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, কারণ এটি ফ্লুইড পদার্থকে বিকৃত বা স্থানান্তরিত করার সহজতাকে প্রভাবিত করে। উদাহরণস্বরূপ, মধুর সান্দ্রতা পানির তুলনায় বেশি, যে কারণে এটি আরও ধীরে ধীরে প্রবাহিত হয়। লুব্রিকেন্ট ডিজাইন করা, মানবদেহে রক্ত প্রবাহ অধ্যয়ন করা এবং আগ্নেয়গিরিতে ম্যাগমার আচরণের পূর্বাভাস দেওয়ার মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে সান্দ্রতা বোঝা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফ্লুইড গতিবিদ্যার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল অশান্ততা (Turbulence)। যখন ফ্লুইড পদার্থের বেগ বিশৃঙ্খল এবং অপ্রত্যাশিত হয়ে যায় তখন অশান্ত প্রবাহ (Turbulent flow) ঘটে। এই ঘটনাটি সাধারণত প্রাকৃতিক ব্যবস্থায়, যেমন নদী, মহাসাগর এবং বায়ুমণ্ডলীয় পরিস্থিতিতে দেখা যায়। তাপ, ভরবেগ এবং দূষণকারী পদার্থের পরিবহনের উপর এই অশান্ততা উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে, যা অনেক প্রকৌশল এবং পরিবেশগত প্রয়োগে এটিকে একটি বিবেচনাযোগ্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় করে তোলে।
ল্যাগ্রাঞ্জিয়ান বর্ণনায় ফ্লুইড গতিকে কণার সমষ্টি হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যার প্রতিটি কণার নিজস্ব অনন্য গতিপথ রয়েছে। পৃথক কণার গতি অধ্যয়ন করে, আমরা তরল আচরণের বিভিন্ন দিক, যেমন কণার পথ, বেগ এবং ত্বরণ সম্পর্কে অন্তর্দৃষ্টি অর্জন করতে পারি। এই পদ্ধতিটি বিশেষ করে এমন ঘটনা বিশ্লেষণের জন্য কার্যকর যেখানে পৃথক কণা বা তরল উপাদানগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যেমন তরল মিশ্রণ, কণা বিচ্ছুরণ এবং তরঙ্গ প্রচার। ল্যাগ্রাঞ্জিয়ান পদ্ধতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োগ পাওয়া যায়। পরিবেশ বিজ্ঞানে, এটি জলাশয়ে দূষণকারী পদার্থের গতিবিধি অনুসরণ করতে ব্যবহার করা যেতে পারে। জৈবযন্ত্রবিদ্যায়, এটি জৈবিক ব্যবস্থায় রক্ত প্রবাহ এবং পুষ্টির পরিবহন অধ্যয়নকে সক্ষম করে। অ্যারোসল, ইমালশন এবং কলয়েডাল সাসপেনশনের আচরণ বোঝার এবং ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষেত্রেও ল্যাগ্রাঞ্জিয়ান কৌশলগুলি মূল্যবান।
অয়লিয়ান পদ্ধতি
ফ্লুইড গতির ক্ষেত্রে অয়লেরিয়ান বর্ণনাটি সুইস গণিতবিদ লিওনহার্ড অয়লারের নামে নামকরণ করা হয়েছে, যিনি ফ্লুইড গতিবিদ্যায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। ল্যাগ্রাঞ্জিয়ান পদ্ধতির বিপরীতে, অয়লেরিয়ান পদ্ধতিটি স্থানের স্থির বিন্দুগুলির উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে, সময় বাড়ার সাথে সাথে সেই বিন্দুগুলিতে তরলের বৈশিষ্ট্যগুলি কীভাবে পরিবর্তিত হয় তা পর্যবেক্ষণ করে।
অয়লেরিয়ান বর্ণনার বার্তা এবং বৈশিষ্ট্য
অয়লেরিয়ান বর্ণনায়, ফ্লুইড প্রবাহ অধ্যয়নের জন্য একটি নির্দিষ্ট রেফারেন্স ফ্রেম ব্যবহার করা হয়। পৃথক কণা অনুসরণ করার পরিবর্তে, এই পদ্ধতিটি স্থানের প্রতিটি বিন্দুতে ফ্লুইড বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন পর্যবেক্ষণের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে, যেমন বেগ, চাপ এবং তাপমাত্রা। এটি ফ্লুইডের সামগ্রিক আচরণ সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য প্রদান করে, যার মধ্যে রয়েছে এর প্রবাহের ধরণ, অশান্ততা (Turbulence) এবং চাপ বিতরণ।
যদিও ল্যাগ্রাঞ্জিয়ান এবং অয়লেরিয়ান উভয় পদ্ধতিই ফ্লুইড গতি সম্পর্কে মূল্যবান অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে, তবুও তাদের পদ্ধতি এবং তারা যে তথ্য প্রদান করে তাতে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রয়েছে। আসুন তাদের মধ্যে কিছু মূল পার্থক্য পরীক্ষা করে দেখি।
পদ্ধতির তুলনা
ল্যাগ্রাঞ্জিয়ান পদ্ধতি পৃথক কণার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে এবং তাদের গতিপথ, বেগ এবং ত্বরণ অনুসরণ করে। এটি ফ্লুইড গতি সম্বন্ধে একটি আণুবীক্ষণিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে, যা কণার মিথস্ক্রিয়া এবং পরিবহনের সাথে জড়িত ঘটনা বিশ্লেষণকে সক্ষম করে। নিরপেক্ষভাবে উচ্ছল ফ্লুইড পদার্থ (Neutrally buoyant fluid particles) অধ্যয়নের জন্য প্রায়শই ল্যাগ্রাঞ্জিয়ান বর্ণনা ব্যবহার করা হয়। এই পদ্ধতিটি বিশেষভাবে বোঝার চেষ্টা করে সেই কণাগুলিকে, যা নিরপেক্ষভাবে উচ্ছল(Neutrally buoyant) এবং তাদের ওপর সান্দ্রতা বা বাহ্যিক ক্ষেত্রের মতো অন্যান্য বলের উপস্থিতিতে কীভাবে কাজ করে। অন্যদিকে, অয়লেরিয়ান পদ্ধতি স্থানের স্থির বিন্দুগুলি বিবেচনা করে এবং সেই বিন্দুগুলিতে ফ্লুইড বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তনগুলি অনুসরণ করে। এটি ফ্লুইড আচরণের একটি ম্যাক্রোস্কোপিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে এবং সামগ্রিক প্রবাহের ধরণ এবং বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণের জন্য উপযুক্ত। ফ্লুইড প্রবাহের অয়লেরিয়ান বর্ণনায়, একটি নিয়ন্ত্রণ আয়তন হল পরিসরের (Space) একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল যার মধ্য দিয়ে ফ্লুইড প্রবাহিত হয় । এই পদ্ধতিটি পৃথক ফ্লুইড কণাদের অনুসরণ করার পরিবর্তে নিয়ন্ত্রিত আয়তনের (Control Volume) মধ্যে নির্দিষ্ট স্থানে ফ্লুইডের বৈশিষ্ট্যের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে ।
এখানে কন্ট্রোল ভলিউম বা নিয়ন্ত্রিত আয়তনের নিয়ে দুএক কথা বলা যাক।
১. কন্ট্রোল ভলিউম কী?
একটি নিয়ন্ত্রণ আয়তন হল পরিসরের (Space) একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল যেখানে আপনি ফ্লুইড প্রবাহ অধ্যয়ন করতে আগ্রহী। এটি একটি স্থির বা চলমান অঞ্চল হতে পারে। নিয়ন্ত্রণ আয়তনের সীমানাকে নিয়ন্ত্রণ পৃষ্ঠ বলা হয়।
ফ্লুইড তার সীমানা পেরিয়ে নিয়ন্ত্রণ আয়তনের মধ্যে এবং বাইরে প্রবাহিত হতে পারে।
ফ্লুইড গতিবিদ্যায় এই দুটি পদ্ধতি গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু বাস্তবে অয়লেরিয়ান বর্ণনা বেশি ব্যবহৃত হয় সি এফ ডি-র কাজে। কম্পিউটেশনাল ফ্লুইড ডাইনামিক্স, বা CFD হল একটি শক্তিশালী হাতিয়ার যা ফ্লুইড প্রবাহের অধ্যয়ন ও বিশ্লেষণ করার পদ্ধতিতে বিপ্লব ঘটিয়েছে। এটি জটিল ফ্লুইড গতিবিদ্যার সমস্যা অনুকরণ করতে, ফ্লুইড আচরণের ভবিষ্যদ্বাণী করতে এবং ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করেই ইঞ্জিনিয়ারিং ডিজাইনগুলিকে কাম্য রূপ দিতে সাহায্য করে।