ফ্লুইড মেকানিক্স ও ভারতীয় বিজ্ঞানীদের কাজ

ফ্লুইড মেকানিক্স ও ভারতীয় বিজ্ঞানীদের কাজ

শুভময় দত্ত
Posted on ২১ ডিসেম্বর, ২০২৪

বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানের দুই বিখ্যাত ঘটনা বিজ্ঞান পাঠকদের কাছে বেশ পরিচিত। ১) ১৯০০ সালে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের শক্তির প্যাকেট-এর ধারণা যা তিনি তাঁর কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণের পরীক্ষা-কে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে পেয়েছিলেন। এই শক্তির প্যাকেট বা কোয়ান্টার ধারণা থেকেই বলা যায় কোয়ান্টাম বলবিদ্যার পথচলার সূত্রপাত। (Planck’s radiation law, October, 1905)।

২) আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব (১৯০৫) যা থেকে পরবর্তীকালে ১৯১৫ সালে সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের বিকাশ ঘটে এবং আমরা মহাকর্ষ সম্পর্কে একটি আধুনিক ধারণা পাই। (On the Electrodynamics of Moving Bodies for Special Theory of Relativity, 30th June, 1905 and The Field Equations of Gravitation for General Theory of Relativity, 30th Nov, 1915)

কিন্তু ওই একই সময় আরেকটি যুগান্তকারী ঘটনা ঘটেছিল ।  ৮ অক্টোবর ১৯০৪ সালে জার্মানির হাইডেলবার্গে তৃতীয় আন্তর্জাতিক গণিত সম্মেলনে বিজ্ঞানী ও গণিতবিদ লুডভিগ প্র্যান্ডটল্ একটি অসামান্য গবেষণাপত্র পড়ে শোনান যার শিরোনাম “On the Motion of Fluids in Very Little Friction “। এখানে একটু বলে রাখা দরকার, আমরা যেকোনো ধরনের বলবিদ্যায় ভর, ভরবেগ ও শক্তির সংরক্ষণ নিয়ে কথা বলে থাকি। তরল বলবিদ্যায় ভরবেগ ও শক্তির সংরক্ষণের ক্ষেত্রে Navier-Stokes সমীকরণটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই সমীকরণের সম্পূর্ণ সমাধান আজও পাওয়া যায় নি, কিছু বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া। প্র্যান্ডটল্-এর এই গবেষণাপত্রের সূত্র ধরে বেরিয়ে এল একটি নতুন তত্ত্ব যার নাম বাউন্ডারি লেয়ার থিওরি। এই তত্ত্বের মাধ্যমে আমরা Navier-Stokes সমীকরণের  প্রায় কাছাকাছি (approximated)  একটি সমাধান দিতে পারি। এতদিন তরল বলবিদ্যা ছিল মূলত গণিতবিদদের চর্চার বিষয়। এবার তা পদার্থবিজ্ঞানী ও ইঞ্জিনিয়ারদেরও গবেষণার এক চমৎকার ক্ষেত্র হয়ে উঠল।

এতক্ষণ ধরে যে বিষয়ের কথা বলা হলো তার ব্যাপ্তি নিয়েও দুচার কথা বলা যাক। ফ্লুইড মেকানিক্স বা তরল বলবিদ্যা হল পদার্থবিদ্যার একটি শাখা যা তরল জাতীয় পদার্থের  ( তরল , গ্যাস এবং প্লাজমা ) গতিবিদ্যা এবং তাদের  শক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত ।  মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং , মহাকাশ , সিভিল , রাসায়নিক এবং বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং , সেইসঙ্গে জিওফিজিক্স , ওশানোগ্রাফি , আবহ বিজ্ঞান , অ্যাস্ট্রোফিজিক্স , এবং জীববিজ্ঞান প্রমুখ বহু বিস্তৃত শাখায় এর প্রয়োগ রয়েছে ৷
তরল বলবিদ্যার বিভিন্ন শাখায় বেশ কিছু আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা ভারতবর্ষ থেকে হয়েছে।
যেমন বিশিষ্ট তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী জয়ন্তকুমার ভট্টাচার্য টারবুলেন্স-এর ওপর অনেক গাণিতিক মডেল তৈরি করছেন যা বিজ্ঞান জগতে খুব পরিচিত।টারবুলেন্স হলো প্রবাহের এমন একটি অবস্থা যখন তরলের ওপর চাপ অনির্দিষ্টভাবে পরিবর্তিত হয়। ওই সময় তরলের মধ্যে একটি অনিশ্চিত ওঠানামা ও সংমিশ্রণ হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়।
আই আই টি খড়গপুরের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-র অধ্যাপক সুমন চক্রবর্তী Biomicrofluidics-এ গবেষণার জন্য আন্তর্জাতিক মহলে সুপরিচিত। শারীরতত্ত্বের বিভিন্ন বিষয়ে আরও গভীরে গিয়ে গবেষণা করতে সাহায্য করে এই বিষয়টি । ক্যান্সারের গবেষণা ও প্যাথোলজির পরীক্ষার বিভিন্ন কিট নিয়ে অধ্যাপক চক্রবর্তী ক্রমাগত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চলেছেন। ২০২২ সালে মাইক্রো ও ন্যানোস্কেল তরল বলবিদ্যায় মৌলিক গবেষণার জন্য তিনি ইনফোসিস পুরস্কার পেয়েছেন।

বিশিষ্ট এরোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ও বিজ্ঞানী রড্ডাম নরসিংহ এবং ফলিত গণিতবিদ কে আর শ্রীনিবাস CSIR-National Aerospace Laboratory-কে আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছে দিয়েছেন । তাঁরা বিভিন্ন বিমানের ডিজাইন নিয়ে পরীক্ষা ও চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন। বিভিন্ন উচ্চতায় তরল বা গ্যাস কীভাবে সেই বিশেষ বিমানগুলির চারপাশে প্রবাহিত হতে পারে তার ক্রিয়া অনুকরণ (সিমুলেশন) করেছেন। ওনার শিষ্যা রমা গোবিন্দরাজনও একজন আন্তর্জাতিক মানের বিজ্ঞানী। নরসিংহ ও গোবিন্দরাজন পুঞ্জ (কিউমুলাস) মেঘ ও বৃষ্টিকণার গতিবিদ্যা নিয়ে অনেক পরীক্ষানিরীক্ষা করে গাণিতিক মডেল নির্মাণ করেছেন যা বিজ্ঞানী মহলে সমাদৃত।
আই আই টি খড়গপুরের অধ্যাপক শুভাশিস দে ২০০২ সালে প্রথম ভারতীয় হিসেবে Hans Albert Einstein পুরস্কার পান। ওনার মূল গবেষণার বিষয় ছিল ফ্লুভিয়াল হাইড্রোডাইনামিক্স। নদী যখন প্রবাহিত হয় তখন সে কতটা পলি সঙ্গে নিয়ে চলে ও জমা করে সেই সংক্রান্ত নানা ভৌত আর রাসায়নিক কারণের ব্যাখ্যা দিয়েছেন তিনি।
Astrophysics -এ তরলবলবিদ্যা নিয়ে জন্মসূত্রে ভারতীয় হিসেবে সবচেয়ে বিখ্যাত নাম অধ্যাপক সুব্রমণিয়াম চন্দ্রশেখরের। ১৯৬১ সালে তাঁর লেখা ‘ Hydrodynamic and Hydromagnetic Stability ‘ বই থেকে তার কিছু আভাস পাওয়া যায় ।  জড়পদার্থের কাছাকাছি আসা বিভিন্ন তরল ও গ্যাস প্রবাহের বাউন্ডারি লেয়ার নিয়ে ওনার বিস্তর গবেষণা আছে।
একটি কৈফিয়ত দিয়ে এই লেখা শেষ করি। বিজ্ঞান গবেষণা বিশ্বজনীন হলেও এখানে আমি ভারতীয় বিজ্ঞানীদের নিয়েই আলোচনা করেছি। কারণ এনাদের কথা প্রচার মাধ্যমে কমই আসে। অথচ এনারা অধিকাংশ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নিয়মিত কাজ করে থাকেন।