নেচার মাইক্রোবায়োলজি’-তে প্রকাশিত একটা গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, ভাইরাস নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করে, নিজের সুবিধার জন্য অন্য ভাইরাসকে বেছে নিয়ে তার সঙ্গে সমন্বিত হয় । এই রকম সমন্বয়ের একটা উদাহরণ হল ইনফ্লুয়েঞ্জা A এবং রেসপিরেটরি সিনসিটিয়াল ভাইরাস। গবেষকরা দেখেছেন এই দুটো ভাইরাস একত্রিত হয়ে একটা হাইব্রিড ভাইরাস তৈরি করে।
ভাইরোলজিস্ট এবং প্রবীণ লেখক পাবলো মুরসিয়া ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় বলেছেন যে এই ধরণের হাইব্রিড ভাইরাসের কথা আগে জানা যায়নি। দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রজাতির ভাইরাস নিজেদের জিনোম এবং বাহ্যিক প্রোটিনের সাথে একত্রিত হয়ে একটা নতুন ধরনের ভাইরাস প্যাথোজেন গঠন করেছে।
গবেষণাগারে প্যাথোজেনের আচরণ, এবং সংক্রমণের উপর পরীক্ষা নিরীক্ষার সময় এই প্যাথোজেন আবিষ্কৃত হয়েছিল। মাইক্রোস্কোপের নীচে এই হাইব্রিড ভাইরাসকে দেখতে অনেকটা একটা ‘গেকোর’ ( টিকটিকি প্রজাতির) পায়ের মতো – যেখানে রেসপিরেটরি সিনসিটিয়াল ভাইরাস (RSV) পায়ের পাতার অংশের মতো দেখতে এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা A ভাইরাস পায়ের আঙ্গুলের মতো দেখতে। মানব দেহের ফুসফুসের কোশকে এই দুটো ভাইরাসের সংস্পর্শে আনা হয়েছিল। পাশাপাশি দুটি ভাইরাসকে কন্ট্রোল গ্রুপ হিসেবেও রাখা হয়েছিল। বিভিন্ন ধরনের মাইক্রোস্কোপিক পরীক্ষা নিরীক্ষায় কিছু আঙুলের মতো আকারযুক্ত হাইব্রিড ভাইরাস দেখা গিয়েছিল ।
যখন এই দুটো ভাইরাস একত্রিত হয়, তখন ইনফ্লুয়েঞ্জা A ভাইরাস অনেক বেশি সংখ্যায় এবং মানব কোশের অনেকাংশ জুড়ে সংক্রমিত করে। ইনফ্লুয়েঞ্জা A ভাইরাস শরীরের প্রতিরোধ শক্তিকে আক্রমণ করে এবং RSV-র পৃষ্ঠের প্রোটিনকে উন্মুক্ত করে ভাইরাসকে বেঁচে থাকার সুবিধা দেয়। যে সমস্ত কোশে ইনফ্লুয়েঞ্জা রিসেপ্টরের থাকে না সেই সমস্ত কোশেও হাইব্রিড ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। এই ইনফ্লুয়েঞ্জা রিসেপ্টর থাকার ফলে ইনফ্লুয়েঞ্জা A ভাইরাস শ্বাসনালীর আরও নীচের দিকে নেমে ফুসফুসে আরও গুরুতরভাবে সংক্রমণ ঘটাতে পারে। অন্যদিকে RSV-র জন্য এই একত্রীকরণ খুব বেশি লাভজনক নয় কারণ ইনফ্লুয়েঞ্জা A-এর উপস্থিতিতে RSV –র প্রতিলিপির ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়। গবেষকদের মতে যেহেতু পরীক্ষাটা একটা গবেষণাগারে সীমাবদ্ধ তাই মানব দেহের শ্বাসতন্ত্রের শারীরবৃত্তীয় জটিলতা এই পরীক্ষায় প্রকাশ পায়নি।
হাইব্রিড ভাইরাসে একত্রিত হওয়ার ফলে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস অন্য ভাইরাসের (RSV) সাহায্য নিয়ে আরও উন্নত মানের হয়ে ওঠে এবং ভাইরাল নিউমোনিয়ার ক্ষেত্রে একটা ভূমিকা নিতে পারে। লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজিস্ট, ডক্টর স্টিফেন গ্রিফিন বলেছেন যে বিভিন্ন ঋতুতে হওয়া ফ্লু ভাইরাসের তুলনায় RSV ফুসফুসের নীচের দিকে চলে যায় এবং গুরুতর সংক্রমণ ঘটায়, ফলে মানুষ আরও অসুস্থ হয়ে পড়ে। তিনি আরও বলেছেন যে আমাদের একাধিক ভাইরাস দ্বারা সংক্রামিত হওয়া থেকে নিজেদের রক্ষা করতে হবে। আমরা যদি আমাদের স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য সতর্কতা অবলম্বন না করি তবে এই ধরনের হাইব্রিডাইজেশন বা সংকরায়ন আরও বেশি সংখ্যায় ঘটতে পারে। ইনফ্লুয়েঞ্জা A ভাইরাসের কারণে প্রতি বছর পাঁচ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হয়, আবার অন্যদিকে RSV –র কারণে শিশুদের মধ্যে শ্বাসনালীর নিম্নভাগের সংক্রমণের প্রবণতা দেখা যায় এবং তাদের পরবর্তী জীবনে পুনরায় এই সংক্রমণ ঘটার সম্ভাবনা থাকে।
গবেষণাটি ভাইরাসের হাইব্রিডাইজেশন বা সংকরায়ন নিয়ে আরও অনেক প্রশ্ন তুলে ধরেছে এবং ভাবা হচ্ছে যে আরও অন্য ধরনের হাইব্রিড ভাইরাস থাকতে পারে যা এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। ভাইরোলজিস্ট এবং লেখক জোয়ান হ্যানি বলেছেন শ্বাসতন্ত্রের ভাইরাস বিভিন্ন ভাইরাস সম্প্রদায়ের একটা অংশ, যারা মানুষের শরীরের একটা নির্দিষ্ট অংশকে আক্রমণ করার চেষ্টা চালায়। প্রতিটা ভাইরাসের জৈব বৈশিষ্টের পূর্ণ চিত্র জানা গেলে বোঝা যাবে, কীভাবে এই ভাইরাসগুলো একে অপরের পরিপ্রেক্ষিতে সংক্রমণ ঘটায়।