বয়সজয়ী নেকেড মোল র‍্যাট

বয়সজয়ী নেকেড মোল র‍্যাট

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৩ অক্টোবর, ২০২৫

বিজ্ঞানীরা অবশেষে খুঁজে পেয়েছেন পৃথিবীর অন্যতম অদ্ভুত প্রাণী নেকেড মোল র‍্যাট/গা-খোলা ইঁদুরের দীর্ঘ জীবনের রহস্য। ছোট্ট এই প্রাণীটি দেখতে খুব একটা আকর্ষণীয় নয়। চামড়াহীন, কুঁচকানো ত্বক। মাটির নীচে এদের বাস। কিন্তু এটি বাঁচে প্রায় ৪০ বছর, যা একই আকারের অন্য স্তন্যপায়ীদের চেয়ে প্রায় দশ গুণ বেশি।

এবার গবেষকরা জানালেন, এর দীর্ঘায়ুর চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে মাত্র চারটি ক্ষুদ্র অ্যামিনো অ্যাসিডের পরিবর্তনে। এই ক্ষুদ্র পরিবর্তন ঘটে গেছে প্রাণীটির এক বিশেষ উৎসেচকে, যার নাম cGAS (cyclic GMP–AMP synthase)। এই উৎসেচকটি আমাদের দেহের জন্মগত রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থার অংশ। এটি দেহের প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অংশ, যা ডিএনএ-তে কোনো সমস্যা বা আক্রমণ শনাক্ত করে রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাকে সক্রিয় করে। কিন্তু নেকেড মোল র‍্যাটের ক্ষেত্রে এই এনজাইমের কাজ কিছুটা ভিন্ন। এটি বয়সজনিত ডিএনএ-র ক্ষতি মেরামতে সাহায্য করে।

প্রকৃতপক্ষে মানুষ ও ইঁদুরের এই উৎসেচক বরং ডিএনএ মেরামতকে বাধাগ্রস্ত করে, ফলে বয়স বাড়ে দ্রুত, আর কোষ দুর্বল হয়ে যায়। কিন্তু মোল র‍্যাটের শরীরে চারটি ক্ষুদ্র অ্যামিনো অ্যাসিড বদলে cGAS হয়ে উঠেছে এক রক্ষাকবচ, যা ডিএনএ-র ক্ষতকে সারিয়ে তুলে কোষকে বয়সের কবল থেকে রক্ষা করে।

ডিএনএ মেরামতের জন্য আমাদের শরীরে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া কাজ করে, যার নাম হোমোলোগাস রিকম্বিনেশন (এইচ আর)। এই প্রক্রিয়ায় কোনো ত্রুটি দেখা দিলে অকাল বার্ধক্য ও কোষের ক্ষয় শুরু হয়। সাধারণত, মানুষ ও ইঁদুরের cGAS এই এইচ আর প্রক্রিয়াকে দমন করে, যার ফলে কোষে মিউটেশন ও ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে।

গবেষক ইউ চেন ও তাঁর সহকর্মীরা আবিষ্কার করেছেন, নেকেড মোল র‍্যাটে এই এইচ আর প্রক্রিয়াটি অস্বাভাবিকভাবে শক্তিশালী এবং উল্টো। তাঁদের পরীক্ষায় দেখা যায় —

এই চারটি বিশেষ অ্যামিনো অ্যাসিড বদলের কারণে মোল র‍্যাটের cGAS সহজে ভাঙে না বা ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না। বরং এটি ডিএনএ-র ক্ষতির পর দীর্ঘ সময় সক্রিয় থেকে FANCI ও RAD50 নামক মেরামতকারী প্রোটিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থাকে। এর ফল হল দ্রুত ডিএনএ মেরামত, সুস্থ কোষ, আর অবাক-করা দীর্ঘ জীবন।

বিজ্ঞানীরা আরও এক চমকপ্রদ পরীক্ষা চালান। তাতে ফলমাছির শরীরে মানব cGAS ঢোকানো হয়, আর মোল র‍্যাটের সেই চারটি অ্যামিনো অ্যাসিড যোগ করা হয়।

অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, সেই ফলমাছিগুলো সাধারণ মাছির চেয়ে অনেক বেশি দিন বেঁচে থাকে।

এই গবেষণা দেখিয়েছে,নেকেড মোল র‍্যাটের দীর্ঘ জীবন শুধুই প্রকৃতির কাকতালীয় বিষয় নয়— বরং এক নিখুঁত বিবর্তনগত প্রকৌশল ।

গবেষক জন মার্টিনেজ ও তাঁর দল লিখেছেন, নেকেড মোল র‍্যাটের cGAS উৎসেচকের এই অপ্রত্যাশিত ভূমিকা প্রমাণ করে, এটি কেবল ইমিউন প্রতিক্রিয়াই নয়, বরং কোষের ভেতরে ডিএনএ রক্ষণাবেক্ষণেও মূল ভূমিকা পালন করে।

এই আবিষ্কার ভবিষ্যতের বার্ধক্যরোধী চিকিৎসা ও দীর্ঘায়ু লাভের গবেষণার নতুন দিক উন্মোচন করেছে।হয়তো একদিন এই ক্ষুদ্র প্রাণীর রহস্য থেকেই মানুষ তার বয়সকে থমকে রাখার কৌশল শিখবে।

 

সূত্র: “A cGAS-mediated mechanism in naked mole-rats potentiates DNA repair and delays aging” by Yu Chen, Zhixi Chen,et.al;( 9.10.2025), Science.

DOI: 10.1126/science.adp5056

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

4 × 2 =