
বরফ পৃথিবীর সবচেয়ে পরিচিত পদার্থগুলোর একটি। হিমবাহ, পর্বতমালা এবং মেরু অঞ্চলগুলোকে বরফ তার সাদা চাদরে আচ্ছাদিত করে রেখেছে। বিজ্ঞানীরা বারবার নতুন নতুন রহস্যের উন্মোচন করছেন এই সাধারণ পদার্থের মধ্যে থেকে। সম্প্রতি স্পেনের ইউনিভারসিটার্ট আটোনোমা ডি বার্সেলনার গবেষক দল, চীনের শিয়ান জিয়াওতং ইউনিভার্সিটি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টোনি ব্রুক ইউনিভার্সিটির সহযোগিতায় একটি গবেষণা চলেছে। তা থেকে জানা যাচ্ছে, বরফকে বাঁকালে বা বিকৃত করলে বৈদ্যুতিক চার্জ তৈরি করতে পারে। এই আশ্চর্য প্রক্রিয়ার নাম ফ্লেক্সোইলেকট্রিসিটি ।এই আবিষ্কার শুধু ল্যাবরেটরির চার দেয়ালে সীমাবদ্ধ নয়, বরং প্রাকৃতিক এক বিশাল রহস্যকেও যথা-বজ্রপাতের উৎপত্তিকেও ব্যাখ্যা করে ।
এতদিন জানা ছিল, বজ্রপাতের সময় মেঘে বরফকণার সংঘর্ষে বৈদ্যুতিক চার্জ জমা হয়। কিন্তু বরফ তো পাইজোইলেকট্রিক নয়। অর্থাৎ শুধু চাপ পড়লে তো বরফে চার্জ তৈরি হওয়ার কথা নয়। নতুন গবেষণা ব্যাখ্যা দিল, বরফ বাঁকলে বা বিকৃত হলে চার্জ তৈরি হয়, আর সেই চার্জ জমেই বজ্রপাতের মতো বিশাল বৈদ্যুতিক শক্তি তৈরি হয়।
গবেষণায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সামনে এসেছে। অত্যন্ত নিম্ন তাপমাত্রায় (-১১৩ºC এর নীচে) বরফের পৃষ্ঠে একটি পাতলা ফেরোইলেকট্রিক স্তর তৈরি হয়। বরফ তখন চৌম্বকের মতো বৈদ্যুতিক মেরুত্ব অর্জন করে, যাকে বাইরের বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র দিয়ে উল্টে দেওয়া যায়। ফলে বরফ একসাথে দুই ধরনের বৈদ্যুতিক আচরণ প্রদর্শন করে, নিম্ন তাপমাত্রায় ফেরোইলেকট্রিসিটি এবং ০ºC পর্যন্ত ফ্লেক্সোইলেকট্রিসিটি।
এই গবেষণা থেকে বোঝা গেল যে বজ্রপাত সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় ফ্লেক্সোইলেকট্রিসিটির একটা বড় ভূমিকা থাকতে পারে। মেঘে বরফকণা যখন একে অপরের সঙ্গে সংঘর্ষে বিকৃত হয়, তখন বৈদ্যুতিক বিভব তৈরি হয় এবং তা জমে উঠে হঠাৎ বজ্রপাতের মাধ্যমে নির্গত হয়।
শুধু প্রাকৃতিক ঘটনাই নয়, এ আবিষ্কার ভবিষ্যতের প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে। সেন্সর, ক্যাপাসিটার বা নতুন ধরনের ইলেকট্রনিক যন্ত্রে বরফকে সক্রিয় উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব হতে পারে।গবেষকরা ইতিমধ্যেই খুঁজছেন আর কীভাবে বরফের এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যকে কাজে লাগানো যায়।
সাধারণ বরফ আসলে এক মস্ত বৈদ্যুতিক শক্তির ভাণ্ডার। হয়তো এখনও এর ভেতরে লুকিয়ে আছে অজানা অগণিত বৈজ্ঞানিক বিস্ময়। বজ্রপাতের রহস্য সমাধান থেকে শুরু করে ভবিষ্যতের প্রযুক্তি পর্যন্ত এই আবিষ্কার বরফকে বিজ্ঞানের জগতে এক নতুন মর্যাদায় পৌঁছে দিল।
সূত্র: “Flexoelectricity and surface ferroelectricity of water ice” by X. Wen, Q. Ma, A. Mannino, et.al;
(27.08.2025), Nature Physics.
DOI: 10.1038/s41567-025-02995-6