বরফ ঢাকা গোপন হ্রদ

বরফ ঢাকা গোপন হ্রদ

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ৬ অক্টোবর, ২০২৫

কুমেরু অঞ্চলের বরফস্তরের গভীরে রয়েছে শত শত গোপন হ্রদ। এদের বলে সাবগ্লেসিয়াল/ হিমবাহ অধঃস্থিত হ্রদ । চোখে দেখা না গেলেও এই হ্রদগুলো অলক্ষ্যে পৃথিবীর সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাকে নিয়ন্ত্রণ করে। ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (ই এস এ)-র ক্রায়োস্যাট উপগ্রহের দশ বছরের পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে দক্ষিণ মেরুর বরফের নীচে আবিষ্কৃত হয়েছে আরও ৮৫টি নতুন হ্রদ। এর ফলে সক্রিয় সাবগ্লেসিয়াল লেকের মোট সংখ্যা এক লাফে বেড়ে দাঁড়াল ২৩১-এ।
এই হ্রদগুলো স্থির নয়, এরা সময়ে সময়ে পূর্ণ হয় আবার খালি হয়ে যায়। এদের জলস্তরের ওঠানামার সঙ্গে পাল্টায় পুরো বরফস্তরের ভর ও গতি। কখনো কখনো কয়েকটি হ্রদ একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে জলপথ তৈরি করে, যা বরফকে দ্রুত সমুদ্রের দিকে ঠেলে নিয়ে যায়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, হ্রদের এই বৈশিষ্ট্য বিশ্ব জুড়ে সমুদ্রপৃষ্ঠর উচ্চতা বৃদ্ধির একটি বড় কারণ।
এই জলাধার পর্যবেক্ষণ খুব সহজ নয়, কারণ তারা কয়েকশ মিটার পুরু বরফের নীচে থাকে। লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক স্যালি উইলসনের দল এখন পর্যন্ত ১২টি নতুন পূর্ণ-চক্র (জল ভরা ও খালি হওয়া) পর্যবেক্ষণ করেছে। এর আগে বিশ্বজুড়ে এমন ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছিল মাত্র ৩৬ বার। অর্থাৎ আবারও একবার আমাদের চোখের সামনে উন্মোচিত হল বরফের তলার এক অভাবনীয় জগৎ।
ই এস এ-র ক্রায়োস্যাট স্যাটেলাইট, ২০১০ সালে উৎক্ষেপিত হওয়ার পর থেকেই এটি বরফস্তরের সামান্যতম পরিবর্তনও নজরে রাখছে। এর রেডার অ্যালটিমিটার বরফ পৃষ্ঠের ওঠানামা সূক্ষ্ম মিলিমিটার স্কেলে ধরতে সক্ষম। যখন বরফের নীচে হ্রদ ভরে ওঠে বা খালি হয়, বরফের পৃষ্ঠও ওঠানামা করে। এই সূক্ষ্ম পরিবর্তন থেকে বিজ্ঞানীরা হ্রদগুলোর অবস্থান, আয়তন ও পরিবর্তনের সময়রেখা চিহ্নিত করতে পেরেছেন। প্রফেসর আনা হগের মতে, সাবগ্লেসিয়াল হ্রদগুলো প্রত্যেকবার ভরা ও খালি হওয়ার সময় ভিন্ন ভিন্ন আকার ধারণ করে। এটি প্রমাণ করে যে অ্যান্টার্কটিকার ভূগর্ভস্থ জলপ্রবাহ অনেক বেশি গতিশীল, যা আগে ধারণা করা যায়নি।
আশ্চর্যের বিষয় হল বর্তমানে ব্যবহৃত সমুদ্রপৃষ্ঠ বৃদ্ধির মডেলে সাধারণত সাবগ্লেসিয়াল জলপ্রবাহকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। অথচ এই গবেষণা দেখিয়েছে এসব হ্রদের অবস্থান, আকার ও পরিবর্তনের তথ্য সংযোজন করলে ভবিষ্যতের সমুদ্রপৃষ্ঠ বৃদ্ধির পূর্বাভাস আরও নির্ভুল হবে , যা উপকূলীয় শহর ও মানুষের ভবিষ্যৎ সুরক্ষায় বড় ভূমিকা রাখবে। ই এস এ-র মার্টিন ওয়েয়ারিং স্পষ্ট করে বলেন, ক্রায়োস্যাটের দৌলতে আমাদের দীর্ঘদিনের ভুল ধারণা বদলালো। এযাবৎ কুমেরু অঞ্চলের বরফস্তরের তলদেশকে যতটা স্থির মনে করা হত, আসলে তা ভেতরে ভেতরে ততটাই প্রাণবন্ত।
এখন প্রশ্ন হল এই হ্রদগুলো কিভাবে তৈরি হয়?
দেখা গেছে, বরফস্তরের নীচে এই হ্রদগুলির গলিত জল মূলত পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ ভূ-তাপে এবং বরফ যখন শিলাস্তরের ওপর দিয়ে সরে যায় তখন সৃষ্ট ঘর্ষণজনিত তাপে তৈরি হয়। এই গলিত জল শিলাস্তরের গায়ে জমে হ্রদে পরিণত হতে পারে এবং সময়ে সময়ে তা নিষ্কাশিতও হয়। এই প্রবাহিত জল বরফ ও শিলাস্তরের মধ্যকার ঘর্ষণ কমায়, ফলে বরফ দ্রুত সরে গিয়ে সমুদ্রের দিকে ধাবিত হয়।
তবে সব সাবগ্লেসিয়াল হ্রদকে সক্রিয় হিসেবে গণ্য করা হয় না। অনেকগুলোকে স্থিতিশীল বলে ধরা হয়, কারণ সেগুলোর নিয়মিতভাবে পূর্ণ বা নিষ্কাশিত হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
সবচেয়ে বড় সাবগ্লেসিয়াল হ্রদ হলো ভোস্টক হ্রদ,যেটি পূর্ব অ্যান্টার্কটিকার বরফচাদরের নীচে অবস্থিত। এর আয়তন আনুমানিক ৫,০০০ থেকে ৬৫,০০০ ঘন কিলোমিটার, যা প্রায় ৪ কিলোমিটার বরফের নীচে জমে আছে। ভোস্টক হ্রদের জলের পরিমাণ এত বিশাল যা গ্র্যান্ড ক্যানিয়নকে পুরোপুরি ভরিয়ে তুলতে পারে এবং তার পরেও অন্তত আরও ২৫% জল উপচে পড়বে।
যদিও বিজ্ঞানীরা মনে করেন ভোস্টক হ্রদ স্থিতিশীল, তবুও যদি এর জল নিষ্কাশিত হয়, তাহলে এর প্রভাব পড়তে পারে অ্যান্টার্কটিকার বরফচাদরের স্থিতিশীলতায়, পার্শ্ববর্তী সমুদ্রের সঞ্চালন ব্যবস্থায়,সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য ও আবাসস্থলে, এমনকি বৈশ্বিক সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতায়ও।

সহজ ভাষায় বলতে গেলে, অ্যান্টার্কটিকার এই হ্রদগুলো পৃথিবীর সমুদ্রপৃষ্ঠের ভবিষ্যতের গুপ্ত নিয়ন্ত্রক। তারা অদৃশ্য হলেও তাদের প্রভাব বিশাল। এই আবিষ্কার শুধু নতুন হ্রদের খোঁজ নয়, বরং জলবায়ু বিজ্ঞানের অজানা টুকরোগুলোকে জোড়া লাগানোর পথে এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ।

সূত্র: “Detection of 85 new active subglacial lakes in Antarctica from a decade of CryoSat-2 data” by Sally F. Wilson, Anna E. Hogg,et.al;(19.09.2025), Nature Communications.
DOI: 10.1038/s41467-025-63773-9

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

15 − 9 =