বাড়তি নিউরন যোগে মস্তিষ্ক-কম্পিউটার ইন্টারফেস

বাড়তি নিউরন যোগে মস্তিষ্ক-কম্পিউটার ইন্টারফেস

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১৭ মার্চ, ২০২৫

যেসব মানুষ কোনো স্নায়বিক কারণে হাঁটতে চলতে বা হাত পা নাড়াতে পারেন না, তাঁরা যদি তাঁদের মনের মাধ্যমে কম্পিউটার কার্সর নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন? অদ্ভুত লাগছে? কিন্তু মগজ-কম্পিউটার মিলনস্থলকে (ইন্টারফেস) কাজে লাগিয়ে পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানুষদের ক্ষেত্রে সীমিত আকারে এমনটা সত্যিই সম্ভব হয়েছে। এবার তার ক্ষেত্র প্রসারণের কাজ চলছে। সায়েন্স কর্পোরেশন সংস্থা বাণিজ্যিক মগজ-কম্পিউটার মিলনস্থল (ব্রেইন -কম্পিউটার ইন্টারফেস বা ‘বিসিআই’ ) নিয়ে কাজ করে। মস্তিষ্কে ছোট ছোট ধাতব তড়িৎদ্বার গুঁজে দেও্যার পুরোনো পদ্ধতির বদলে, জৈবিক পদ্ধতিতে এই বিসিআইকে আরও নিরাপদে, আরও উন্নত যোগাযোগের ক্ষেত্র হিসাবে ব্যবহার করাই এঁদের গবেষণার লক্ষ্য। এইসব জটিল প্রশ্নের সমাধান করতে পারে বাড়তি নিউরন যোগ – বলেছেন অ্যালান মারডিনলি, এই সংস্থার সহ-প্রতিষ্ঠাতা। এঁরা একটি চৌকো চৌকো খোপ ওয়ালা ময়দার ‘ওয়াফেল’ খাবারের মতো দেখতে যন্ত্রর নকশা বানিয়েছেন যাতে লাখ লাখ নিউরন মস্তিষ্কপৃষ্ঠে স্থাপন করা যায় কোনো ধাতব তড়িৎদ্বার ছাড়াই।
কোম্পানির গবেষকরা ইঁদুরের উপর যন্ত্রটি পরীক্ষা করেছেন। সেখানে বাড়তি নিউরনগুলো ইঁদুরদেরকে যন্ত্রের মাধ্যমে বাঁদিকে কিংবা ডানদিকে চলতে শেখায়। এই গবেষণা ভবিষ্যতের মগজ-কম্পিউটার মিলনস্থল (ইন্টারফেস) তৈরির একটা ভিত্তি রচনা করছে, যা এখনকার বিসিআই-এর মতো মস্তিষ্কের ক্ষতি করে না। ওয়াফেল সদৃশ এই বিসিআই, মস্তিষ্কের ভেতরের নিউরনগুলোকে বাইরের কম্পিউটারের সাথে সংযুক্ত করে। গবেষকরা পাতলা, নরম আর অপেক্ষাকৃত ছোট যন্ত্র তৈরি করেছেন যা নিউরনগুলোকে কম্পিউটারের সাথে বৈদ্যুতিকভাবে সংযুক্ত করে এবং নিউরন ও রক্তনালীর ক্ষতি করে না। এই নতুন যন্ত্রকৌশলটি মস্তিষ্কের ভেতরে কিছু স্থাপন করার বদলে, মস্তিষ্কর উপরে বসায়। এটি কিন্তু নিছক মস্তিষ্কপৃষ্ঠের উপরে লাগানো একটি ফলক নয়—এটি নিউরনে পূর্ণ। নিউরনগুলো একটি খোপওয়ালা ওয়াফেল সদৃশ যন্ত্রের মধ্যে থাকে। মস্তিষ্কপৃষ্ঠে নিউরন-পার্শ্ব নিচের দিকে মুখ করে স্থাপন করা হয়। নিউরনগুলো মস্তিষ্কের ভেতরে প্রবাহিত হয়ে যন্ত্র এবং মস্তিষ্কের কোষকলার মধ্যে একটি আঠার মতো কাজ করে। এই জৈব সংকর প্রযুক্তির উদ্দেশ্য হলো, শরীরে প্রতিস্থাপিত যন্ত্রগুলিতে জৈব উপাদান যোগ করা। “জৈব সংকর প্রযুক্তি ধারণাটা পুরোনো”, বলেছেন মারডিনলি। বিসিআই গবেষণায় এটি কখনো জনপ্রিয় হয়েছে, কখনো বা জনপ্রিয়তা হারিয়েছে। ৯০-এর দশকে প্রাথমিক বিসিআই গবেষণায় এটির প্রথম আবির্ভাব। তারপরে আবার এখন। তবে, ধারণাটি জটিল, কারণ নিউরনগুলো ভঙ্গুর আর তার ওপর এতদিন বিসিআই প্রযুক্তি সাধারণভাবে আরো মজবুত তড়িৎদ্বার (ইলেকট্রোড) বসানোর দিকেই ঝুঁকে পড়ছিল।
জৈব-সংকর যন্ত্রটি নির্মাণের প্রক্রিয়ার শুরু একেবারে ল্যাবের টেবিল থেকে। ‘প্রাথমিক কর্টিক্যাল উত্তেজনা-সঞ্চারী নিউরন’ নামে পরিচিত বিশেষ একধরনের নিউরন সংকেত পাঠায় প্রতিবেশী নিউরনগুলিকে। এটি একই প্রজাতির ইঁদুরের ভ্রূণের স্টেম সেল থেকে প্রস্তুত করা হয়। নিউরনগুলোকে যুগপৎ জিনতত্ত্ব আর আলোকবিজ্ঞানের (অপটোজেনেটিক) বৈশিষ্ট্যযুক্ত করতে এগুলিতে পরিবর্তন আনা হয়। নির্দিষ্ট কম্পাঙ্কের আলো এসে এদের ওপর আঘাত করলে নিউরনগুলো সংকেত প্রেরণ করে। যন্ত্রটির উপরে ছোট ছোট কুয়োর মতো সরা (মাইক্রোওয়েল) রয়েছে। সরাগুলোর প্রতিটির ব্যাস ১০ মাইক্রোমিটার। প্রতিটি কুয়ো-সরায় থাকে একটি করে নিউরন। প্রতিটি যন্ত্রের আকার প্রায় ৫ বর্গ মিলিমিটার। এটি গড়ে ৯০,০০০ নিউরন ধারণ করতে পারে। জৈব-সংকর যন্ত্রকৌশলের নিউরনগুলো মস্তিষ্কবল্কলের (কর্টেক্সের) শীর্ষ অংশে বৃদ্ধি পায় এবং রক্তবাহগুলি নতুন নিউরনে পরিণত হয়। তবে মস্তিষ্কে, নিউরন সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেই যে জৈব-সংকর যন্ত্রটি মস্তিষ্কের কার্যকারিতায় পরিবর্তন আনতে পারবে তা কিন্তু নয়। গবেষকরা একটি ইঁদুরের খুলির মধ্যে একটি কাচের জানালা মারফত যন্ত্রে আলো ফেলেন। সেই আলো নতুন নিউরনগুলোকে চালু করে দেয়। যন্ত্রে আলো পড়লে ইঁদুরগুলো খাঁচার বাঁদিকে যেতে শিখে পুরস্কার (খাবার) পায়। একইভাবে আলো বন্ধ হলে ডান দিকে যেতে শিখে পুরস্কার পায়। নতুন এই আলোক- সংবেদি নিউরনগুলি নয়টি ইঁদুরের মধ্যে পাঁচটিকে নতুন আচরণ শেখার কাজে সহায়তা করেছে। মারডিনলি মনে করেন, এটা তাদের বাহ্যিক আচরণ নিয়ন্ত্রিত হওয়ার প্রমাণ।
মস্তিষ্কের ওপরে রোপিত কৌশলটির নিচেকার মস্তিষ্কের ছবি তুলে দেখা গেল, নিউরনের কোষদেহ থেকে নির্গত সংকেতবাহী লম্বা লম্বা সরু তন্তুগুলি (অ্যাক্সন) মস্তিষ্কের একেবারে উপরিতলের পুরু কোষস্তর ( পিয়া ম্যাটার) ভেদ করে মস্তিষ্কবল্কলের স্তর ১ পর্যন্ত চলে এসেছে।
ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈদ্যুতিক ইঞ্জিনিয়ারিঙের অধ্যাপক জ্যাক জুডি বলেছেন, এই জৈব সংকর যন্ত্রকৌশলটিকে এখনো মগজ আর কম্পিউটারের একটি যথার্থ মিলনস্থল বলা যাচ্ছে না। কারণ “মিলনস্থল মানে হল, যন্ত্রকৌশলটির ভিতর থেকেই তথ্য নির্গত হতে হবে’। তবে এটুকু বলা যায় একটি আলোক-মিলনস্থল তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় কোষকলা তৈরির পথটা প্রশস্ত হচ্ছে।
সায়েন্স কর্পসের দল ইতিমধ্যেই মস্তিষ্কের ইনপুট এবং আউটপুট নিয়ে ভবিষ্যতের জৈব সংকর যন্ত্র তৈরি করতে শুরু করেছে। সেই যন্ত্রগুলিতে কুয়োর বদলে খালের মধ্যে নিউরন রাখা হয়েছে। খালের এক পাশ থেকে এলইডি আলো গিয়ে পড়বে নিউরনের ছোট দলের ওপর। অন্য পাশের বিদ্যুৎ সংযোগগুলি নিউরনদের কর্ম সম্ভাবনা রেকর্ড করবে। মারডিনলি বলেছেন , “ এটি একটি জটিল নকশা”। গবেষণা দলের সদস্যরা স্বীকার করেন যে মস্তিষ্কের ওপরে রোপিত ব্যবস্থাটি থেকে নির্গত নিউরনগুলি মস্তিষ্কের ভিতরে ঠিক কী পরিমাণে সংহত হয়, তা বলা মুশকিল। এখনো অনেক কিছুই অজানা। বিশেষ করে কেন নয়টির মধ্যে চারটি ইঁদুর কাজ শিখতে পারল না, তা বোঝা যাচ্ছে না।
গবেষণার পরবর্তী বড়ো মাইলফলকটি হবে মানুষের দেহ থেকে কোষ নিয়ে একটা জৈব সংকর যন্ত্রকৌশল বানানো যা একই সঙ্গে রেকর্ড করবে আবার উদ্দীপনাও জোগাবে। তারপর সেটা কোনো বড়ো প্রাণীর ক্ষেত্রে কাজ করে কিনা তা পরখ করে দেখা।
সূত্র: ‘Biohybrid BCI Adds More Neurons to the Brain’, IEEE SPECTRUM, 19 February 2015

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

two × four =