বিজ্ঞানের চোখে স্প্যাগেটির অন্তর্জগৎ

বিজ্ঞানের চোখে স্প্যাগেটির অন্তর্জগৎ

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১ নভেম্বর, ২০২৫

ইদানিং ইতালির গণ্ডি পেরিয়ে এই বঙ্গদেশেও স্প্যাগেটি বেশ জনপ্রিয়। এই স্প্যাগেটির ভেতরের জগৎ কতটা জটিল, তা জানলে অবাক হতে হয়। সুইডেনের লুন্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি স্প্যাগেটির ভেতরের অণুস্তর বিশ্লেষণ করে এমন কিছু চমকপ্রদ তথ্য আবিষ্কার করেছেন যা সাধারণ রান্নার ধারণাকেও বদলে দিতে পারে। তারা বলছেন,স্প্যাগেটির দৃঢ়তা বা স্থায়িত্ব নির্ভর করে মূলত গ্লুটেন নামক এক প্রোটিনের উপর। এই গ্লুটেন একটি জালের মতো কাঠামো তৈরি করে, যা সিদ্ধ অবস্থায় স্পাগেটি – র ভেতরের স্টার্চ কণাগুলোকে ধরে রাখে, ভেঙে পড়তে দেয় না। যখন গরম জলে ফোটানো হয়, তখন সেই গ্লুটেন জাল পাস্তার ভেতরের অণুস্তরকে একত্রে বেঁধে রাখে। ফলস্বরূপ পাস্তা থাকে লচকদার, অক্ষত ও স্বাদে ভারসাম্যপূর্ণ। কিন্তু যাদের জন্য গ্লুটেন-মুক্ত খাবার তৈরি করা হয়, তাদের জন্য সমস্যা অন্য রকম। গ্লুটেন না থাকায় স্প্যাগেটির ভিতরে সেই জাল তৈরি হয় না। ফলে সিদ্ধ করার সময় সহজেই পাস্তা ফেটে যায় বা আকার হারায়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এটাই গ্লুটেন-মুক্ত পাস্তার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ – গঠন অটুট রাখা। আমরা সাধারণত ভাবি, লবণ কেবল স্বাদ বাড়ানোর জন্যই ব্যবহার হয়। কিন্তু এই গবেষণা প্রমাণ করেছে, লবণ স্প্যাগেটির কাঠামোতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। লবণ মিশিয়ে পাস্তা সিদ্ধ করা হলে লবণ গ্লুটেন জালের সঙ্গে রাসায়নিকভাবে যুক্ত হয়। এতে গ্লুটেন আরও স্থিতিশীল হয় এবং পাস্তা রান্নার সময় ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। বিজ্ঞানী আন্দ্রেয়া স্কোত্তি বলেন,“যদি রান্নার সময় একটু বেশি লবণও পড়ে যায়, তবু সাধারণ পাস্তা তার গঠন ঠিক রাখে। কারণ গ্লুটেন-লবণের পারস্পরিক সংযোগ পাস্তাকে অতিরিক্ত সহনশীল করে তোলে।“অর্থাৎ, পাস্তা সিদ্ধ করার সময় লবণের পরিমাণ শুধুই স্বাদ নয়, গঠন ও টেক্সচার রক্ষার জন্যও অপরিহার্য। এই রহস্য উদ্ঘাটনে গবেষকরা ব্যবহার করেছেন অত্যাধুনিক প্রযুক্তি – ক্ষুদ্র-কোণ নিউট্রন ছড়ানো এবং এক্স-রে বিশ্লেষণ। এই পদ্ধতির সাহায্যে তাঁরা দেখতে পান, পাস্তার ভেতরের গ্লুটেন ও স্টার্চ কণাগুলো ন্যানোমিটার স্তরে (এক মিটারের একশো কোটি ভাগের এক ভাগ) কেমনভাবে সাজানো ও পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত থাকে। এই অণুস্তরের মানচিত্র তৈরি করে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পেরেছেন, সিদ্ধ জলে গ্লুটেন জাল কীভাবে প্রসারিত হয়, লবণ কীভাবে তার স্থিতি বাড়ায়, আর গ্লুটেন-মুক্ত বিকল্পগুলো কোথায় দুর্বল হয়ে পড়ে। গবেষক দলটি এখন কাজ করছেন এমন উপাদান নিয়ে যা গ্লুটেন ছাড়াই গ্লুটেনের মতো জাল তৈরি করতে পারে। তাঁদের লক্ষ্য, গ্লুটেন-মুক্ত পাস্তা তৈরি করা। এটা রান্নার সময় ভেঙে পড়বে না এবং খাওয়ার সময়েও স্বাভাবিক পাস্তার মতোই স্বাদ ও গঠন বজায় রাখবে। স্কোত্তি বলেন, “গ্লুটেন-মুক্ত বিকল্পের চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে। আমাদের এই বিশ্লেষণী পদ্ধতিগুলো এমন পাস্তা তৈরি করতে সহায়তা করবে যা রান্নার তাপ ও ভোক্তার প্রত্যাশা- দু’টোই সামলাতে পারবে।“গবেষণাটি শুধু স্প্যাগেটির নয়, পুরো খাদ্যবিজ্ঞানের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। প্রতিদিনের খাবারও জটিল ভৌত-রাসায়নিক কাঠামোর ফল। গ্লুটেন ও লবণের মাইক্রো-সমন্বয় কেবল স্বাদই নয়, খাবারের গঠন ও স্থায়িত্বও নির্ধারণ করে। খাদ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই গবেষণার ফল ভবিষ্যতে আরও উন্নত পাস্তা ও গ্লুটেন-মুক্ত খাবার তৈরিতে সহায়ক হবে। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, বিজ্ঞান রান্নাঘরের ভেতরেও থাকে, আমরা তা খেয়ালই করি না।

সূত্রঃ “A small-angle scattering structural characterization of regular versus gluten-free spaghetti” by J.E. Houston, R. Schweins, N.P. Cowieson, G.N. Smith and A. Scotti, 27 August 2025, Food Hydrocolloids.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

twelve − 8 =