রবীন্দ্রনাথের এক ব্যঙ্গকৌতুকে একজন গোঁড়া হিন্দুর কথা আছে। তিনি বিশ্বাস করেন যে, প্রাচীন ভারতীয় ঋষিরা অক্সিজেন বাষ্প এবং গ্যালভানিক ব্যাটারি আবিষ্কার করেছিলেন। কোনো শাস্ত্রে এদের উল্লেখ পাওয়া যায় না, এই যুক্তির বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিযুক্তি খুব সহজ। মুসলমানেরা যখন এত মন্দির ধ্বংস করেছে আর এত হিন্দুর মাথা কেটে ফেলেছে, তখন যে-সব বইতে অক্সিজেন ও ব্যাটারির কথা আছে, সেগুলোও নিশ্চয়ই তারা পুড়িয়ে ফেলেছে। শেষে তাঁর গভীর খেদোক্তি – হায়, ইংরেজিশিক্ষিত আধুনিক ভারতবাসী হয়তো বলবে, প্রাচীন ভারতের বাতাসে অক্সিজেনই ছিল না, বা প্রাচীন ভারতের আকাশ বিদ্যুৎ খেলাবার মতো এনলাইটেন্ড ছিল না। এই লোকটি হাসির খোরাক হতে পারে, কিন্তু খেয়াল করে দেখুন যে, এর যুক্তি নস্যাৎ করা খুব শক্ত, অসম্ভবও বলা যায়। বিশ্বসুদ্ধু সবাই ষড়যন্ত্র ক’রে আপনাকে এবং আপনার সংস্কৃতি ঐতিহ্য ধর্ম ইত্যাদিকে চেপে দিতে চাইছে, এটা একরকম মানসিক ব্যাধি। এটা ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত হতে পারে। বিশেষ ক’রে পরাজিত হৃতগৌরব গরীব জাতি সহজে প্যারানয়েড মানসিকতার শিকার হয়, তাদের মধ্যে অতীতকে খুঁটে খাওয়ার এই প্রবণতার দেখা আরো বেশি ক’রে মেলে। তারা পৃথিবীর মুখের সামনে চিৎকার ক’রে বলতে থাকে, আমাদেরও সব ছিল, তোমাদের চেয়ে আমরা কোনো অংশে কম নই, আমরা শুধু দুনিয়াজোড়া এক মহাষড়যন্ত্রের শিকার, তাই আজ আমাদের কেউ পাত্তা দেয় না, অথচ তোমরা যা আবিষ্কার করেছ ব’লে দাবি করো, তার সবই আমরা আরো অনেক আগে ক’রে রেখেছি। আমাদের পরম দুর্ভাগ্য যে, আজ সারা দেশে এই উৎকট মানসিক ব্যাধির প্রকাশ ঘটে চলেছে। আরো বেশি দুর্ভাগ্য, এটা ঘটছে সরকারী মদতে। দক্ষিণপন্থী রাজনীতি জাতীয়তাবোধের ব্যবসা করতে গিয়ে দেশের সব কিছুকেই ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তোলে। হিটলারও তুলেছিলেন কিন্তু জার্মান বিজ্ঞানের একটা নিজস্ব গৌরবময় ঐতিহ্য ছিল। আমাদের দেশে এই চেষ্টা হাস্যকর ভাঁড়ামোর নামান্তর হয়ে দাঁড়ায়। কারণ, আমরা শুধু অতীতের রোমন্থন করি না, কাল্পনিক অতীতের রোমন্থন করি। অথচ প্রাচীন ভারতের বিজ্ঞানচর্চার ইতিহাস যথেষ্ট সমৃদ্ধ, বিশেষ ক’রে গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, রসায়ন ও চিকিৎসাশাস্ত্রে। এ-বিষয়ে অনেক মূল্যবান বই ও আলোচনা আছে, উৎসাহী পাঠকপাঠিকা প’ড়ে দেখতে পারেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ এ-নিয়ে একেবারেই অবহিত নন। চরক-সুশ্রুতের চিকিৎসাবিদ্যা, বা শূন্যের আবিষ্কার, এর বাইরেও ভারতীয় বিজ্ঞানের অনেক অবদান ছিল, আরবিদের মাধ্যমে তা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। বাখশালী পাণ্ডুলিপি (যেখানে প্রথম শূন্যের দেখা মেলে), শুল্বসূত্র, মাধব-জ্যেষ্ঠদেবের কেরালা স্কুল আমাদের গণিতের উজ্জ্বল ইতিহাস; আর্যভট-বরাহমিহির-ব্রহ্মগুপ্তের জ্যোতির্বিদ্যা বা নাগার্জুনের রসায়ন ও ধাতুবিদ্যার গবেষণা নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি। বিজ্ঞানে ভুল হয়, আমাদের প্রাচীন বিজ্ঞানীরাও কিছু কিছু ভুল করেছেন (যেমন জ্যোতির্বিদ্যার ক্ষেত্রে অয়নচলনের হিসেব), কিন্তু তাতে তাঁদের কাজের গুরুত্ব কিছুমাত্র কমে না। আমাদের দক্ষিণপন্থী রাজনীতিকের দল যদি ভারতীয় বিজ্ঞানের গৌরবময় অধ্যায় হিসেবে এঁদের কথা তুলে ধরতেন, কেউ খুব একটা আপত্তি করতেন না। বিজ্ঞান এখন অনেক এগিয়ে গেছে, এখন আর কেউ এঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করবেন না, কিন্তু একটা জাতির সভ্যতার মানদণ্ডে তার বিজ্ঞানচর্চার ইতিহাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অথচ এইসব রাজনীতিকেরা অর্ধশিক্ষিত আমজনতার মন ভোলানোর জন্যে নানারকম গালগল্প গাঁজাখুরি কবিকল্পনা এবং অপবিজ্ঞানের আশ্রয় নিলেন। আমাদের দেশে যে বিজ্ঞানের চর্চা হয়, তারও মূল পশ্চিমে, সুতরাং পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের সঙ্গে লড়তে গেলে ভারতীয় অপবিজ্ঞানই ভরসা। জ্যোতিষ কোনো বিজ্ঞান নয়। বিমান শূন্যে ভেসে থাকতে বা পিছনে যেতে পারে না। গোবর গোমূত্র বা গোরুর থেকে পাওয়া অন্যান্য জিনিসের কোনো অপ্রাকৃত গুণ নেই। গোরু অক্সিজেন ছাড়ে না (বরং ঘাসপাতা হজমের সময় প্রচুর মিথেন গ্যাস ছেড়ে গ্রিনহাউস ক্রিয়ায় বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা বাড়ায়)। ময়ূর চোখের জল দিয়ে বংশবৃদ্ধি করে না। প্রাচীন ভারতে ফাইটার জেট বা পরমাণু বোমার সমতুল্য অস্ত্র ছিল না। এ কথাগুলো আমরা সবাই জানি কিন্তু নব্যহিন্দুত্বের ধ্বজাধারীরা এ সবই মিথ্যে প্রমাণ করতে চাইছেন। বাল্মীকি বা ব্যাসদেবের কবিকল্পনাকে সত্যি ব’লে ভেবে নিলে তো বিংশ শতকের বাঙালীদেরও সর্বরোগহর মিরাকিউরল বা শত্রুনাশক অ্যানাইহিলিন বন্দুক আবিষ্কারের কৃতিত্ব দিতে হয়। কেউ বলছেন ডারউইনের তত্ত্ব ভুল। কেউ বলছেন নিউটনের সূত্র অনেক আগেই বেদে লেখা আছে (মেঘনাদ সাহার সেই বিখ্যাত উক্তি স্মর্তব্য)। এই তালিকা অন্তহীন। এখন এইসব অপবিজ্ঞানকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা চলছে। ভারতে বিজ্ঞানের ভবিষ্যৎ অন্ধকার বললে অত্যুক্তি হয় না। একদল মানুষ প্রতিবাদ করছেন, সামান্য কিছু রাজ্য সরকারও রুখে দাঁড়িয়েছে, ফল কতোটা হবে সময়ই বলবে, কারণ দেশে অশিক্ষিত এবং অর্ধশিক্ষিতদের রমরমা, তারা সত্যিকারের শিক্ষিতদের অবজ্ঞা ও অপমান ক’রেই বেশি আনন্দ পায়, সঙ্গে একটু মোটা দাগের জাতীয়তাবাদ বুলিয়ে নিলে তো কথাই নেই। বেদ = হিন্দু = ভারত সমীকরণের কুনাট্য রাজ্যে রাজ্যে (বিশেষ করে উত্তর ও মধ্য ভারতে) অভিনীত হয়ে চলেছে। রাজনীতিক থেকে ধর্মগুরু, জজ থেকে জ্যোতিষী, কেউ বাদ নেই। খেয়াল করলে দেখবেন, এই সব অপবিজ্ঞানের প্রবক্তারা প্রায় সকলেই উচ্চবর্ণের হিন্দু এবং এঁদের জাতীয়তাবোধের উৎস হল তীব্র মুসলিম-বিদ্বেষ। এই ভাবধারার মূল কোথায়, তাও আমরা সবাই জানি। তাই, কেউ যদি আপনাকে বলেন, বেদের শ্লোকে বিজ্ঞান লুকিয়ে আছে, আমাদের ঋষিরা যা ব’লে গেছেন বহু শতাব্দী পরে পশ্চিম সেগুলোই পুনরাবিষ্কার করেছে, দয়া ক’রে জানতে চাইবেন ঠিক কোথায় এই মূল্যবান শ্লোকগুলো আছে। এইসব কথা যারা বলে বেড়ান, তাঁরা পড়াশুনো ক’রে সময় নষ্ট করেন না। আরো একটি উদাহরণ দিই। সম্প্রতি ভারতের ‘বিখ্যাত’ ধর্ষক নিত্যানন্দ স্বামী আইনস্টাইনের প্রসঙ্গে মুখ খুলেছেন। হয়তো তাঁর মনে হয়েছে যে সারাজীবন অনেক তো হলো, পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের উপর বলাৎকারটাই বা বাদ থাকে কেন! সুতরাং স্থান এবং কাল নির্বাচন ক’রে তিনি তাঁর গঞ্জিকাসেবনলব্ধ নির্বোধ ভারতীয় দর্শনের মদমত্ততা জাহির করেছেন। সে বেশ করেছেন, ও কাজ ক’রে আজকাল অনেকেই খ্যাতি পেয়েছেন ও পাচ্ছেন। বিপদটা অন্যত্র। ধর্ষক মহারাজের এখনো নিশ্চয়ই অনেক শিষ্য (এবং শিষ্যা) আছেন, তাঁরা গুরুবাণী পরম পবিত্র মনে ক’রে জপ করবেন। সম্ভবত কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে পিটুনিও দেবেন। এঁরা বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর থেকে সমর্থনও পাবেন। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের এইসব মুখের বিরোধিতা করলে আপনি ‘শহুরে নকশাল’ থেকে ‘দেশদ্রোহী’ পর্যন্ত অনেক খেতাব পাবেন, ভাগ্যে থাকলে জেলও। জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার পরিসরটা ক্রমশ কমে আসছে। এ বড়ো সুখের সময় নয়। প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধের দায়িত্ব আমাদেরই। এবং হাতে আর সময় নেই।