বিজ্ঞান, ভাষাতত্ত্ব, ইতিহাস, ভূগোল

বিজ্ঞান, ভাষাতত্ত্ব, ইতিহাস, ভূগোল

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ৩০ এপ্রিল, ২০২৫

পৃথিবীতে মানুষ প্রায় সাত হাজারটি ভাষায় কথা বলে। ভাষাগুলিকে পাঁচটি বৃহৎ পরিবার বা গোষ্ঠীতে ভাগ করা হয়। তার মধ্যে সবচেয়ে বড়ো পরিবারটি হল ‘ইন্দো-ইউরোপীয় গোষ্ঠী’। সংস্কৃত, ইংরেজি, ফরাসি, গ্রিক, লাতিন,  পারসিক,  বাংলা, মরাঠি, হিন্দি সবই সেই গোষ্ঠীর অন্তর্গত। ১৭৮৬ সালে এই ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষাগোষ্ঠীর ব্যাপারটি প্রথম  লক্ষ্য ও ব্যাখ্যা করেন কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা উইলিয়াম জোন্স (১৭৪৬-১৭৯৪)। কিন্তু কোথা থেকে এর আদি উৎপত্তি, সেটা এখনো কিছুটা বিতর্কিত। জোন্সের মতে, বর্তমান ইরান ভূখণ্ডই ছিল এর আদি উৎপত্তিস্থান।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই ‘ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষাগোষ্ঠী’ কথাটি কিন্তু উইলিয়াম জোন্সের নয়, বহুবিদ ব্রিটিশ মিশরতত্ত্ববিদ, ডাক্তার ও  পদার্থবিজ্ঞানী টমাস ইয়ং (১৭৭৩-১৮২৯)-এর।  তিনিই ১৮১৩ সালে এই কথাটি প্রথম প্রয়োগ করেন। তাঁর মতে, ইরান নয়, বর্তমান কাশ্মীর অঞ্চলই এর আদি উৎপত্তির জায়গা।

 

ছবি- টমাস ইয়ং

টমাস ইয়ং ছিলেন এক বিস্ময় বালক। তেরো বছর বয়সে তিনি লাতিন, গ্রিক, ফরাসি আর ইতালীয় ভাষা খুব ভালো করে শিখে ফেলেছিলেন। অল্পকাল পরেই  হিব্রু, ক্যাল্ডীয়, সিরিয়াক, সামারিটান, আরবি, ফার্সি, তুর্কি আর ইথিওপীয় ভাষা নিয়ে চর্চা শুরু করেন। ১৮০৪ সালের পর থেকে তিনি প্রধানত ডাক্তারি আর ভাষাতত্ত্ব চার্চাতেই মনোনিবেশ করেন। মিশরী চিত্রলিপি উদ্‌ঘাটনে তাঁর অবদান বিপুল। তিনটি ভাষায় লিখিত একটি বার্তা-সংবলিত ‘রোসেটা প্রস্তর-ফলক’ থেকে মিশরী চিত্রলিপির পাঠোদ্ধার করেন তিনি। অপরদিকে চোখ আর আলোকবিদ্যা নিয়ে তাঁর গবেষণাও কালজয়ী। ‘ইয়ং-এর মডিউলাস’ পদার্থবিজ্ঞানের একটি অতি মূল্যবান সূত্র।

কিন্তু জোন্স কিংবা ইয়ং কেউই সিন্ধু সভ্যতার খবর পাননি। কারণ ১৯২০এর দশকে জন মার্শাল,  রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় আর আলেকজান্ডার কানিংহ্যাম সাড়ে পাঁচ হাজার বছরের পুরোনো মহেঞ্জোদরো ও হরপ্পার ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেন। কিন্তু সে-সভ্যতার লিপির পাঠোদ্ধার আজও হয়নি। তবে সে-ভাষা ইন্দো-ইউরোপীয় গোষ্ঠীভুক্ত ছিল বলে মনে হয় না।

ইন্দো-ইউরোপীয় আদি-ভাষার উৎপত্তি নিয়ে নানারকম আলাপ আলোচনা তর্কবিতর্ক আজও অব্যাহত। মোটামুটি ১৯৬০ সালের পর থেকে অনেক পণ্ডিত মেনে নেন যে রাশিয়া, ইরান, আজারবাইজান, তুর্কমেনিস্তান আর কাজাকাস্তান সংলগ্ন কৃষ্ণ সাগর এবং বুলগেরিয়া আর রোমানিয়া সংলগ্ন কাস্পিয়ান সাগর অঞ্চলই এর আদিভূমি। জিনতত্ত্ব এই তত্ত্বকে সমর্থন করছে। ২০১৫য় নেচার পত্রিকায় এ বিষয়ে দুটি আলাদা গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। দুটিতেই প্রাচীন মানবের ডি এন এ বিশ্লেষণের ভিত্তিতে গবেষকরা এই সিদ্ধান্তে আসেন যে হাজার পাঁচেক বছর আগে ওই অঞ্চলের  শিকারী, ফল সংগ্রাহক আর যাযাবররা পূর্বমুখে এশিয়া অভিমুখে আর পশ্চিম মুখে ইউরোপ অভিমুখে ছড়িয়ে পড়ে। ওইসব জায়গার মানবের মোট জিন সম্ভারের ৯০ কিংবা ততোধিক শতাংশে তারা নিজেদের চিহ্ণ রেখে গেছে। আজকের ইউরোপের জীবিত পুরুষদের অধিকাংশের দেহে এবং মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার কোটি কোটি পুরুষের দেহে যেসব ওয়াই-ক্রোমোসোম রয়েছে তারা এসেছে ওই আদি তৃণভূমি অঞ্চল থেকে।

ছবি- কাস্পিয়ান সি

জিনতত্ত্বের দিক থেকে এই সমর্থন পাওয়ায় বোঝা যাচ্ছে কেন আইসল্যান্ড আর ভারত, ইংল্যান্ড আর ইরান, স্পেন আর নরওয়ের মতো দূর দূর দেশের মানুষের ভাষার মধ্যে এমন সব মিল রেয়েছে যাকে পিছিয়ে নিয়ে গেলে একটি আদি ভাষায় পৌঁছে যেতে হয়। তবে সেই  আদিতম ভাষাটি  একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় এ বিষয়ে একেবারে নিশ্চিত হওয়া মুশকিল।

দেখবার বিষয় এই যে ভাষাতত্ত্ব, পুরাতত্ত্ব, জিনতত্ত্ব আর নৃতত্ত্ব – এই এতগুলি বিষয়ের সমন্বয়ে এগিয়ে চলেছে এই গবেষণা।

 

কৃতজ্ঞতা: Andrew Robinson, ‘How the world’s largest language family spread …’, Nature, 28 April 2025

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

1 × three =