বিবর্তন ও গর্ভধারণ: সংঘাত নয়, সহযোগিতা

বিবর্তন ও গর্ভধারণ: সংঘাত নয়, সহযোগিতা

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১৫ জুলাই, ২০২৫

ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণায় গর্ভধারণের বিস্ময়কর বিবর্তনের ইতিহাস উন্মোচন করেছেন। ছয়টি স্তন্যপায়ী প্রাণীর ওপর পরিচালিত এই গবেষণায় দেখা গেছে, গর্ভধারণ শুধু মা ও ভ্রূণের মধ্যে সংঘাত নয়, বরং ১০ কোটি বছরেরও বেশি সময় ধরে বিবর্তিত এক গভীর সহযোগিতামূলক প্রক্রিয়া। ভ্রূণ ও মায়ের মধ্যে পুষ্টি ও সংকেত বিনিময়, গর্ভনাড়ির আক্রমণাত্মক বৈশিষ্ট্য এবং নতুন ধরনের হরমোন উৎপাদনের ক্ষমতাই দীর্ঘমেয়াদি সফল গর্ভধারণের মূল ভিত্তি। গবেষণা থেকে দেখা যায়, মা-ভ্রূণের সম্পর্ক জটিল হলেও তা মূলত সুসমন্বিত সহযোগিতার ওপর নির্ভরশীল।
গর্ভাবস্থায় মা ও অনাগত সন্তানের মধ্যে একটি বিশেষ বন্ধন তৈরি হয়। এই সম্পর্কটি কেবল শারীরিক নয়, মানসিক এবং কিছুটা আবেগেরও বটে। গর্ভাবস্থায় মায়ের শরীর এবং ভ্রূণের মধ্যে এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যেখানে মা ভ্রূণকে সুরক্ষা দেন এবং ভ্রূণ মায়ের শরীর থেকে পুষ্টি ও অক্সিজেন গ্রহণ করে। এই সম্পর্কটি মা ও সন্তানের ভবিষ্যৎ স্বাস্থ্য এবং বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
স্তন্যপায়ী প্রাণীদের গর্ভে ভ্রূণের সাথে মায়ের জরায়ুকে সংযোগকারী গর্ভনাড়ি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।এই গর্ভনাড়ির মাধ্যমে দুইটি আলাদা জিনগত সত্তা মা ও ভ্রূণের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ও অবিরাম পারস্পরিক বিনিময় চলে। এই জটিল কাঠামোটি যথেষ্ট সংবেদনশীল। এ এমনভাবে কাজ করে যাতে পুষ্টি ও সংকেত বিনিময় অব্যাহত থাকে, আবার এটাও নিশ্চিত করে যাতে মায়ের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভ্রূণকে শরীর-বহির্ভুত অনাকাঙ্ক্ষিত উপাদান মনে করে আক্রমণ না করে বসে।

গবেষকরা একক কোষের জিনগত কার্যকলাপ বিশ্লেষণের মাধ্যমে ছয়টি প্রাণীর কোষ পর্যবেক্ষণ করেন – ইঁদুর, গিনিপিগ, ম্যাকাক বানর, মানুষ, টেনরেক (একটি প্রাথমিক গর্ভনাড়িযুক্ত স্তন্যপায়ী) এবং থলিতে করে বাচ্চা বহনকারী জাতের ওপোসাম যা, জটিল গর্ভনাড়ি বিবর্তনের আগে গর্ভনাড়িযুক্ত স্তন্যপায়ী প্রাণী থেকে বিভক্ত হয়েছিল। এই গবেষণায় দেখা গেছে, ভ্রূণের গর্ভনাড়ি কোষের আক্রমণাত্মক বৈশিষ্ট্য, যা আগে মানুষসহ কিছু প্রাণীর মধ্যে সীমিত বলে মনে করা হতো, সেটি আসলে স্তন্যপায়ী প্রাণীদের বিবর্তনের এক গভীর ও সংরক্ষিত বৈশিষ্ট্য।
এছাড়া গবেষণায় প্রমাণ মিলেছে, থলিতে করে বাচ্চা বহনকারী প্রাণী বাদে অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে নতুন ধরনের হরমোন উৎপাদনের ক্ষমতা বিবর্তিত হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি ও জটিল গর্ভাবস্থার জন্য এটির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এ থেকে বোঝা যায়, , মা ও ভ্রূণ পরস্পরের বিবর্তনে প্রভাব রেখেছে।

গবেষণায় আরও দুটি তত্ত্ব যাচাই করা হয়েছে। “ডিস্যামবিগুয়েশন হাইপোথিসিস” বা দ্ব্যর্থতা নিরসন প্রকল্প অনুযায়ী, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হরমোনের সংকেতগুলি মায়ের বা ভ্রূণের উৎসকে নির্দিষ্টভাবে আলাদা করেছে, যাতে বিভ্রান্তি এড়ানো যায়। অপরদিকে, “এস্কেলেশন হাইপোথিসিস” বা জিনগত সংঘাতের প্রকল্প অনুসারে, মা ও ভ্রূণের জিনের মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে প্রছন্ন সংঘাত লক্ষ করা যায়, বিশেষ করে IGF2 জিনে, যা বৃদ্ধির জন্য দায়ী।
সব মিলিয়ে গবেষণাটি থেকে দেখা যায়, গর্ভধারণ মোটেই সংঘাত নয় বরং সুপরিকল্পিত সহযোগিতার ফল। এই আবিষ্কার ভবিষ্যতে গর্ভকালীন জটিলতা বা রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসায় নতুন দিশা দেখাতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

five + eighteen =