শৈলেন্দ্র সিং। ভারতে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের অন্যতম এক যোদ্ধা। বিশেষভাবে বলতে হলে, বিলুপ্তপ্রায় কছপ প্রজাতিকে বাঁচিয়ে রাখার লড়াইয়ে এই মানুষটির নিঃশব্দ লড়াই শুধু মানুষ নয় প্রাণীদেরও বোধহয় মুগ্ধ করে দিয়েছে! ২০০৫-এ বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের নিশ্চিন্ততার চাকরি প্রত্যাখান শৈলেন্দ্র করেছিলেন শুধু বিলুপ্ত হতে চলা কচ্ছপদের কয়েকটি প্রজাতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য! ২০২১-এ কচ্ছপ সংরক্ষনের কাজের জন্য সরকারের দেওয়া পুরষ্কার নেওয়ার সময় অবাক বিস্ময়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকা কয়েকজন কেন্দ্রীয় সরকারের আধিকারিকের মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছিল, “ভারতেও তাহলে এরকম মানুষ আছেন!”
ভারতে মিষ্টি জলের কচ্ছপে রয়েছে ২৯টি প্রজাতি। তার মধ্যে ১৭টি প্রজাতির কচ্ছপ বিপন্ন। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে তাদের চাহিদা। অবৈধভাবে তাদের শিকার করে, মেরে সেই বাজারে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবসা বহুবছর ধরে চলছে।
মিষ্টি জলের কচ্ছপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় জলের ইকোসিস্টেম বজায় রাখার, বলছেন শৈলেন্দ্র। এই প্রজাতির কচ্ছপই জল পরিষ্কার রাখে। নদীতে থাকা অনেক অকাজের, আক্রমণাত্মক মাছ এই কচ্ছপগুলো খেয়ে নেয়। তাতেও অন্য সামুদ্রিক প্রাণী এবং অন্যান্য মাছেরা সুস্থভাবে বাঁচতে পারে। মিষ্টি জলের সেই কচ্ছপের ১৭টি প্রজাতি আজ বিপন্ন। শৈলেন্দ্র জানিয়েছেন, ১৭টি প্রজাতির কচ্ছপের মধ্যে যে ৬টি প্রজাতি বিপন্ন হয়ে গিয়েছে তারা হল বাটাগুর গুসকা, বাটাগুর কাছুগা, নীলসোনিয়া নিগ্রিকানস, চিত্রা ইনডিকা, পাংশুরা সিনথেসিস, মনোরিয়া ফারি।
গত ১৩ বছর ধরে লড়াই চলছে শৈলেন্দ্রর। ভারতে কচ্ছপ সংরক্ষণ প্রধানত যে সংস্থা করে সেই টিএসএ বা টার্টল সারভাইভাল অ্যালায়েন্সের হয়ে শৈলেন্দ্রর এক বিরল কৃতিত্ব ছয়টি বিপন্ন ওই কচ্ছপের প্রজাতির সঙ্গে আরও একটি বিরল প্রজাতির কচ্ছপকে বিলুপ্ত হওয়া থেকে উদ্ধার করে আনা।
ভারত-নেপাল সীমান্তে ছোট্ট একটা গ্রাম জারওয়াল রোড। সেখানে শৈলেন্দ্রর বেড়ে ওঠা। বাড়ির কাছেই কাতারনিয়া অভয়ারণ্য। শৈলেন্দ্রর একটা স্বভাব ছিল শৈশব থেকেই। স্থানীয় পুকুরে গিয়ে ছোট ছোট কচ্ছপের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করা। তার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকা! তার কয়েক বছর পর, শৈলেন্দ্র একটি পোষা প্রাণীর দোকান থেকে দু’টো ভারতীয় টেন্ট প্রজাতির কচ্ছপ কিনেছিলেন। তাদের নিয়ে পড়ে থাকতে থাকতেই কচ্ছপের প্রতি ভালবাসা জন্মায় শৈলেন্দ্রর। লখনউ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিবেশ বিজ্ঞান নিয়ে স্নাতকোত্তর হওয়া এবং টিএসএ-তে যোগ দেওয়া-শৈলেন্দ্রর নেশা আর পেশা এক হয়ে যাওয়ায় ওর পক্ষে লড়াই চালিয়ে যাওয়াটা কিছুটা সহজ হয়েছিল বলেও জানিয়েছেন শৈলেন্দ্র।
২০০৩-এ গোমতী নদীর তীর থেকে শৈলেন্দ্রর কচ্ছপ বাঁচানোর লড়াইয়ের শুরু। অবৈধভাবে কচ্ছপ মেরে তাদের বাজারে পাঠিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো ছিল শৈলেন্দ্রর প্রাথমিক কাজ। কচ্ছপদের পাহারা দেওয়া, তাদের ডিমদের পাহারা দেওয়া এবং ডিমগুলোকে আবার পরিষ্কার জলে ভাসিয়ে দেওয়ার কাজ-গোমতী নদীর তীর থেকে চম্বল নদীর তীর জুড়ে এভাবেই কচ্ছপ প্রজাতির সংরক্ষণ করে গিয়েছেন শৈলেন্দ্র। আর সেই সময়, মানে ২০০৬ নাগাদ চম্বল নদীতে শৈলেন্দ্র সন্ধান পান বাটাগুর কাছুগা আর বাটাগুর ধোংকা নামের বিরল প্রজাতির দুই কচ্ছপের। শৈলেন্দ্র ও তার টিএসএ-র সহকর্মীরা এই সময় চালু করেছিলেন একটি প্রকল্প। নাম রিয়ার অ্যান্ড রিলিজ। মধ্যপ্রদেশের ইটাওয়াতে তৈরি হওয়া এই প্রকল্পের কাজ ছিল চম্বল নদীর তীরবর্তী বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে বাটাগুর কাছুগা আর বাটাগুর ধোংকার ডিম খুঁজে বার করা এবং তাদের আবার জলে ভাসিয়ে দেওয়া। একইসঙ্গে মধ্যপ্রদেশ সরকারকে অবিরাম চাপ দিয়ে বিরল বিপন্ন প্রজাতির কচ্ছপদের সংরক্ষণের জন্য আলাদাভাবে পুকুর বানিয়ে নেওয়া। শৈলেন্দ্র জানিয়েছেন, কম বাধা আসেনি এই কাজ করতে গিয়ে। চোরাকারবারিদের পেছনে ব্যবসায়ীদের আর্থিক সহায়তা থাকে। তাই শৈলেন্দ্রর মত মানুষদের কাছে প্রাথমিকভাবে লড়াইটা কঠিন হয়। কিন্তু অদম্য মানসিক শক্তিতে সেই বাধা অতিক্রম করেছেন শৈলেন্দ্র।
আজ তিনি একা নন। তার টিএসএ-ও একা নয়। চম্বল ও গোমতী নদীর তীরবর্তী অঞ্চল জুড়ে শৈলেন্দ্ররা তৈরি করেছেন কমিউনিটি প্রোগ্রাম। মানে স্থানীয় অঞ্চলের ৩৫ স্কুলকে জড়িয়ে নিয়েছেন এই কাজে! শিশু ও কিশোর মিলিয়ে এখন ৪ হাজারেরও বেশি মানুষ বিরল প্রজাতির কচ্ছপ বাঁচানোর কাজে ব্যস্ত! আর তার প্রতিফলন? ২০০৮-এ গোমতী আর চম্বল নদী মিলিয়ে শৈলেন্দ্র দেখেছিলেন মাত্র ১৩টি বাটাগুর গুস্কা। আজ সেই বাটাগুর গুস্কার সংখ্যা ৩৮০টা!
ভারতেও তাহলে এরকম মানুষ আছেন!