
আফ্রিকান সিচলিড প্রজাতির মাছের বিরাট পুরু ঠোঁট, জীববিজ্ঞানী তথা মৎস্য সংরক্ষণকারীদের কাছে এক বিস্ময়। ভিক্টোরিয়া, মালাউই এবং টাঙ্গানিকা হ্রদে পাওয়া যায় এই অনন্য বৈশিষ্ট্যের মাছগুলিকে। গবেষকদের মনে প্রশ্ন , তাদের এত বড় ঠোঁট কিভাবে এবং কেন বিবর্তিত হয়? বিজ্ঞানীরা এই মাছের ঠোঁটের গঠন এবং জিনের অভিব্যক্তি তুলনা করে নতুন অনুসন্ধানের চেষ্টা করছেন। সিচলিডের বড় ঠোঁটের কারণ চিহ্নিত করার জন্য তাঁরা আণুবীক্ষণিক বিবরণ এবং আণবিক তথ্য পরীক্ষা করছেন। গবেষকরা দেখেন, বিভিন্ন হ্রদের মাছের একই রকম বৈশিষ্ট্য দেখা গেলেও, তারা একে অপরের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত নয়। তাদের এই ঠোঁটের বৈশিষ্ট্যের পুনরাবৃত্তিকে ‘সমান্তরাল বিবর্তন’ বলা হয়। এই প্রক্রিয়া, প্রায়শই পরিবেশগত কারণে ঘটে। ‘সমান্তরাল বিবর্তন’ , ‘প্রাকৃতিক নির্বাচনে’র প্রমাণ। হার্ভাডের বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানী জোনাথন লোসার্স একথা লিখেছেন। ভিক্টোরিয়া হ্রদ বা মালাউই কিংবা টাঙ্গানিকার বিচ্ছিন্ন বাস্তুতন্ত্রগুলিতে সিচলিড প্রজাতি স্বাধীনভাবে বেড়ে উঠেছে। অথচ, তাদের মধ্যে কিছু বৈশিষ্ট্য একরকম। ‘সমান্তরাল বিবর্তন’কে অধ্যয়নের এটি একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তিনটি হ্রদের প্রজাতিগুলির তুলনা করে বিজ্ঞানীরা এমন কিছু নিদর্শন সনাক্ত করেন যা একক স্থানে থাকলে হয়ত চোখে পড়ত না। কিন্তু একই রকম পরিবেশগত পরিস্থিতি , এই বিবর্তনের কিরূপ পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছে তা দেখার জন্য, এটি একটি বিরল সুযোগ। বিস্তারিত বিশ্লেষণ থেকে জানা গেছে, তাদের পুরু ঠোঁটে প্রোটিওগ্লাইক্যান সমৃদ্ধ স্তর থাকে।প্রোটিওগ্লাইক্যান একটি বৃহৎ অণু, যার সাথে চিনির দানার মিল রয়েছে। কখনও কখনও এটি অতিরিক্ত জল ধরে রাখার কাজে আসে। এটি হাড়, তরুণাস্থি, কণ্ডুরা এবং ত্বকসহ বিভিন্ন কোষ-সমাবেশে প্রাপ্ত একটি কাঠামোগত উপাদান। কোষ গঠন, কোষের সিক্ততা বজায় রাখা এবং কোষের যান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য নির্মাণে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সাধারণ ঠোঁটওয়ালা মাছের মধ্যে এই প্রোটিওগ্লাইক্যান বিশেষ লক্ষ্য করা যায় না। বড় ঠোঁটের সিচলিডদের উপর গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে, তাদের ঠোঁটে, কনড্রয়েটিন সালফেট, প্রোটিওগ্লাইক্যান সহ বেশ কিছু প্রোটিন প্রচুর পরিমাণে পাওয়া গেছে। এই সংমিশ্রণটি কোষের আয়তন বৃদ্ধি করে এবং ঠোঁটগুলিকে আরও মোটা করে তোলে। আরো দেখা গেছে, মাছগুলির জিন অভিব্যক্তির পার্থক্য প্রত্যাশার অনেক আগেই শুরু হয়ে যায়। কিশোর অবস্থাতেই বিশেষ করে ঠোঁটগুলি সম্পূর্ণ ঘন হওয়ার আগেই, বহি:কোষীয় ‘ম্যাট্রিক্স’ উপাদান তৈরির জন্য দায়ী জিনগুলি আরও বেশি সক্রিয় হয়ে থাকে। তাদের ঠোঁটের এই হাইপারট্রফি বা কোষের আকার বৃদ্ধি, জীবনের প্রথম দিকেই তৈরি হয়। মাছেরা পরিপক্ব হওয়ার সাথে সাথে সেটি আরও শক্তিশালী হয়ে যায়। বিকাশের সময় এই জিনগুলির ক্রমাগত প্রকাশ, কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত ব্যাবস্থার ইঙ্গিত দেয়। যার জন্য ঠোঁটের এইধরনের বৈশিষ্ট্যগুলি, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তারা টিকিয়ে রেখেছে। বিজ্ঞানীরা wnt সিগন্যালিং নেটওয়ার্কের সাথে জড়িত জিনের পরিবর্তনগুলিকে লক্ষ্য করেন। Wnt নেটওয়ার্ক হল প্রোটিনের একটি জটিল জালিকা ব্যবস্থা, যা কোষ বৃদ্ধি, চলাচল এবং বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জিনের বিকাশের সময় এটি বিশেষ প্রভাব ফেলে। তবে প্রাপ্তবয়স্কদের কোষের রক্ষণাবেক্ষণ এবং মেরামতেও এটি বিশেষ সহায়ক। এই পথটি অনেক প্রাণীরই বৃদ্ধি এবং বিকাশের ক্ষেত্রটিকে প্রভাবিত করে। কিছু সিচলিডের ঠোটের আকার বেশ বড। তাদের কিশোর এবং প্রাপ্তবয়স্ক উভয়ের ক্ষেত্রেই wnt সম্পর্কিত জিনের উচ্চ প্রকাশ লক্ষ্য করা গেছে। এর থেকে বোঝা যায় সময়ের সাথে সাথে এটি আরও সক্রিয় হতে থাকে। কোষগুলির প্রসারণ ঘটাতে এবং বহিঃকোষীয় উপাদান জমা করতে এটি সাহায্য করে। সাম্প্রতিক গবেষণায় সিচলিডের বড় ঠোঁট এবং মানুষের মধ্যে অপ্রত্যাশিত যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া গেছে। মাছের ঠোঁটে পাওয়া প্রোটিওগ্লাইকক্যান মানুষের ত্বকের রোগের সাথেও জড়িত। যেখানে অতিরিক্ত সংযোজক কোষ উত্থিত হয় এবং দানার সৃষ্টি করে। মাছ এবং মানুষ উভয় ক্ষেত্রেই এই অণুগুলির প্রচুর পরিমাণে তরল ধরে রাখার ক্ষমতা আছে এবং এটি কোষগুলিকে প্রসারিত হতে সাহায্য করে। গবেষকদের ধারণা, সিচলিডগুলিতে প্রোটিন কিভাবে আচরণ করে তা জানতে পারলে সেটা মানুষ সহ অন্যান্য প্রাণীদের মধ্যে সংযোগকারী কোষগুলি সম্পর্কেও ধারণা দেবে, এই কোষগুলি কিভাবে বৃদ্ধি পায় বা অতিরিক্ত মাত্রায় বৃদ্ধি পায় সে সম্পর্কে তথ্য যোগাবে। জীববিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরেই মোটা ঠোঁটের পরিবেশগত উপকারিতা নিয়ে বিতর্ক চালিয়ে আসছেন। অতীতের গবেষণাগুলি থেকে জানা গিয়েছিল এই ঠোঁট, মাছকে পাথুরে ফাটল খুঁজে বার করতে বা খাবার খোঁজার সময় সাহায্য করতে পারে। আরেকটি গবেষণা বলে, অতিরিক্ত ঠোঁটের পরিসর পরিবেশগত সংকেতের সাথে সাথে, যোগাযোগের কাজটিকেও সহজ করে দেয়। যেমন, আফ্রিকান গ্রেট লেকের গোলকধাঁধায় শিকার সনাক্ত করতে সাহায্য করতে পারে অদ্ভূত মোটা এই ঠোঁট। পূর্ব আফ্রিকান গ্রেট লেকের পরিবেশ ভাগাভাগি হওয়া সত্ত্বেও, প্রতিটি সিচলিড প্রজাতির মাছের ঠোঁট, হাইপারট্রফিক হয় না। কারণ বৈশিষ্ট্যটি বংশানুক্রমে চলে আসছে। খাদ্য সংগ্রহের ধরন বা খাদ্যাভ্যাস সম্ভবত জিনগত প্রবণতার সাথে মিথস্ক্রিয়া করে। যে সমস্ত প্রজাতির ঠোঁট মোটা হওয়ায় সুবিধাগুলি যথেষ্ট শক্তিশালী হয় না, সেখানে ঠোঁটের বৃদ্ধির জন্য দায়ী জিনগুলি নিশক্রিয় হতে থাকে। সেগুলি ভিন্নভাবে বিকশিত বা ভিন্নভাবে অভিযোজিত হয়। জেনেটিক গবেষণায় সিচলিডের জিনোমে একাধিক উপাদান চিহ্নিত করা হয়েছে যা তাদের ঠোটের বিশালত্বকে প্রভাবিত করতে পারে। প্রতিটি উপাদান আপাতদৃষ্টিতে বিশাল ঠোটের বৈশিষ্ট্যের বিস্তৃত এবং জটিল প্রক্রিয়া তৈরি করে।