
প্রায় ২০ বছর ধরে আলোচনার পর অবশেষে জাতিসংঘে গৃহীত হলো “হাই সিস ট্রিটি” বা ‘বিশ্বজনীন সমুদ্র চুক্তি’। সারা বিশ্বের মহাসাগরের দুই-তৃতীয়াংশ আন্তর্জাতিক জলসীমা। এতদিন কোনো দেশের আইনগত নিয়ন্ত্রণে ছিল না। তা এতদিনে একটি আন্তর্জাতিক কাঠামোর আওতায় আসছে। রাষ্ট্রসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এ চুক্তিকে “মহাসাগরের প্যারিস চুক্তি” আখ্যা দিয়েছেন। তাঁর মতে, এটি কেবল সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য নয়, বস্তুত মানবজাতির ভবিষ্যৎ রক্ষার জন্যও অপরিহার্য। সমুদ্র পৃথিবীর অক্সিজেনের অর্ধেক সরবরাহ করে। গোটা বিশ্বের জলবায়ু নিয়ন্ত্রণে এর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ । কিন্তু অতিরিক্ত মাছ ধরা, প্লাস্টিক দূষণ, খনিজ আহরণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্র ভয়াবহ হুমকির মুখে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক জলসীমায় কার্যকর সুরক্ষা ব্যবস্থা না থাকায় সেখানে জীববৈচিত্র্যের অবক্ষয় দ্রুত বেড়েছে। মেরিন কনজারভেশন ইনস্টিটিউটের গবেষক ড. লিসা শোয়ার্জ বলেন, “এই চুক্তি ছাড়া উচ্চ সমুদ্র ছিল একপ্রকার ‘খোলা অরণ্য ’। এখন অন্তত একটি বৈশ্বিক আইনগত কাঠামো দাঁড় করানো গেল।”
ক. সুরক্ষিত সমুদ্র অঞ্চল : আন্তর্জাতিক সমুদ্র এলাকায় বিশেষ অঞ্চল তৈরি করা হবে, যেখানে মাছ ধরা, তেল বা গ্যাস অনুসন্ধান এবং অন্যান্য বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড সীমিত বা নিষিদ্ধ থাকবে। খ.জীববৈচিত্র্য ভাগাভাগি: সমুদ্রের জিন ঘটিত সম্পদ থেকে প্রাপ্ত সুবিধা ধনী ও দরিদ্র দেশের মধ্যে সমভাবে ভাগ করা হবে।
গ. বৈজ্ঞানিক সহযোগিতা: উন্নত দেশগুলি তাদের প্রযুক্তি ও গবেষণা তথ্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর সঙ্গে ভাগ করবে।
ঘ. টেকসই ব্যবহার: সামুদ্রিক সম্পদ আহরণে টেকসই নীতি বাধ্যতামূলক হবে।
বিশ্বজনীন সমুদ্র অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে এখনও অনেকটাই অজানা। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই চুক্তি গবেষণার জন্য নতুন দ্বার খুলে দেবে। জেমস কুক বিশ্ববিদ্যালয়-এর সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানী প্রফেসর অ্যান্ড্রু বেনসন মন্তব্য করেন, “সঠিক তথ্য ছাড়া আমরা সমুদ্র সংরক্ষণ করতে পারব না। এই চুক্তি গবেষণার জন্য এক বৈপ্লবিক সুযোগ এনে দিয়েছে।” সুরক্ষিত সমুদ্র অঞ্চল ঘোষণার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা এখন প্রবাল প্রাচীরের ক্ষয়, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং নতুন প্রজাতি আবিষ্কারে আরও নির্ভুল তথ্য সংগ্রহ করতে পারবেন। চুক্তিটি ২০২২ সালে গৃহীত “৩০x৩০ লক্ষ্য” বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। ঐ লক্ষ্য অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীর ৩০ শতাংশ স্থল ও সমুদ্র এলাকা সুরক্ষিত রাখতে হবে। বিশেষভাবে উপকৃত হবে ছোট দ্বীপ এবং রাষ্ট্রগুলো, যেমন প্রশান্ত মহাসাগরের কিরিবাতি বা মালদ্বীপের মতো দেশগুলি, যাদের অর্থনীতি সরাসরি সমুদ্রনির্ভর। বিশ্ব নীতির মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলার কাজেও নতুন সহায়তা মিলবে। তবে এর বাস্তবায়ন সহজ হবে না। কোন অঞ্চল সুরক্ষিত হবে, কীভাবে তহবিল আসবে, এবং সমুদ্র সম্পদের বণ্টন কীভাবে হবে- এসব বিষয়ে দেশগুলির মধ্যে মতপার্থক্য রয়ে গেছে। গ্লোবাল ফিশারিজ অ্যালায়েন্সের সমালোচকরা আশঙ্কা করছেন, কিছু বড় শিল্পোন্নত দেশ অর্থনৈতিক স্বার্থের কারণে সীমাবদ্ধতা মানতে গড়িমসি করতে পারে। তা সত্ত্বেও, বিশেষজ্ঞরা মনে করেন “বিশ্বজনীন সমুদ্র চুক্তি” আন্তর্জাতিক পরিবেশ নীতির ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী প্রাপ্তি। এটি কেবল সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য নয়, মানবসভ্যতার ভবিষ্যৎ টিকিয়ে রাখার জন্যও অপরিহার্য। রাষ্ট্রসংঘের মহাসচিবের কথায়, “আমাদের মহাসাগর রক্ষা মানে আমাদের ভবিষ্যৎ রক্ষা।”
সূত্র: “Landmark High Seas Treaty marks new era of global ocean protection” By Sanjana Gajbhiye; Earth.com; 23.09.2025