বিশ্ববীণারবে / ষষ্ঠ পর্ব

বিশ্ববীণারবে / ষষ্ঠ পর্ব

অর্পণ পাল
Posted on ১৪ নভেম্বর, ২০২১

পৃথিবীর আকার এবং আহ্নিক গতি নিয়ে কিছু কথা

মহাকাশ থেকে পাঠানো বিভিন্ন কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে তোলা ছবিতে দেখা যায় পৃথিবীকে ঠিক কেমন লাগে ওখান থেকে দেখতে। তবে সেইসব ছবিতে পুরো পৃথিবীর ছবি প্রায় দেখাই যায় না, কারণ পৃথিবীর একটা অংশ সবসময়েই অন্ধকারে ঢাকা থাকে।

ছবি। মহাশূন্য থেকে পৃথিবীকে কেমন দেখায়।

পৃথিবীর আকার কেমন, এ নিয়ে বহুকাল ধরেই চর্চা করেছে মানুষ, তারপর ধারণার বিবর্তন হতে হতে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আমরা অনেকটাই সহজে বলতে পারি ঠিক এমন দেখতে পৃথিবীকে। যদিও আগেকার আমলের সেইসব মানুষেরা, যাঁরা এই পৃথিবীর বুকে দাঁড়িয়েই বিভিন্ন পরোক্ষ প্রমাণের সাহায্যে পৃথিবী যে গোল এটা প্রমাণ করেছিলেন, তাঁদের প্রতিভাকে কুর্নিশ করতেই হয়। তবে তাঁদের ধারণার বিবর্তনের সে ইতিবৃত্ত আমরা অন্য অধ্যায়ে বলব।

পৃথিবী নামক এই গ্রহের এখন অব্দি বয়স সাড়ে চারশো কোটি বছরের কিছু বেশি, ঠিকঠাক বললে বলতে হয় ৪.৫৪৩ বিলিয়ন বছর, বা চারশো চুয়ান্ন কোটি তিরিশ লক্ষ বছর। প্রায় গোলাকার এই পৃথিবীসহ মোট আটটি গ্রহ সূর্য নামক একটি সাধারণ আকারের নক্ষত্র বা তারার চারপাশে পাক খাচ্ছে। রাতের আকাশে (সূর্যের অনুপস্থিতিতে) আরও অসংখ্য জোনাকির মতো তারা আমরা দেখতে পাই, যদিও তারাদের দেখতে অতি ক্ষুদ্র, প্রায় বিন্দুর মতো মনে হয়; কিন্তু আসলে তারা সবাই সূর্যের মতো (কোনো কোনোটা তো আবার সূর্যের চেয়েও অনেকগুণ বড়) নক্ষত্র। এদের সব কয়টারই মোটামুটি একটাই সাধারণ আকার— গোলকাকার। যদিও আমাদের এখন এটা বেশ জানা আছে যে পৃথিবীর আকার পুরোপুরি গোলাকারও নয়, তার ওপর এবং নিচের দিকটা খানিক চাপা— এই বিশেষ আকারকে আমরা বাংলায় ‘অভিগত গোলকাকার’ বলি। যদিও ইংরেজিতে একে বলা হয় ‘Geoid’। আবার কোথাও কোথাও লেখা থাকে, পৃথিবী হল ‘irregularly shaped ellipsoid’ বা অনিয়মিত আকারের উপবৃত্তাকার ত্রিমাত্রিক বস্তু।

পৃথিবীর উত্তর-দক্ষিণ বরাবর দৈর্ঘ্য বা ব্যাস পূর্ব পশ্চিম বরাবর ব্যাসের চেয়ে কিছুটা কম (একটা তথ্য, নিরক্ষীয় অঞ্চলে পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে সমুদ্রতল অব্দি যা দূরত্ব, মেরু অঞ্চলে সেই দূরত্বের মান প্রায় একুশ কিলোমিটার কম)। আবার পৃথিবীর আকার অনিয়মিত হওয়ারও বেশ কিছু কারণ রয়েছে। প্রথমত, পৃথিবীপৃষ্ঠে বহু পাহাড়-পর্বত থাকায় বেশ কিছু স্থান সমুদ্রতলের চেয়ে বেশ উঁচু, কোথাও আবার জলতলের চেয়ে বেশ নিচু জায়গাও রয়েছে, সেগুলোর জন্যেও মোটের ওপর পৃথিবী গোলাকার নয়। আবার প্রবলবেগে ঘুরতে থাকবার কারণে পৃথিবীর মাঝখানের দিকটা স্বাভাবিক নিয়মেই (যে কোনো ঘূর্ণায়মান বস্তুরই মাঝের দিকটা ফুলে ওঠে, ওপর নিচ চাপা হয়ে যায়) উঁচু হয়ে গিয়েছে অর্থাৎ মেরু অঞ্চল যেন কিছুটা চেপে গিয়েছে। অন্যদিকে আমরা এটাও নিশ্চয়ই জানি যে দিন-রাতের সব সময় পৃথিবীর আকার একই রকম থাকে না। প্রধানত চাঁদ এবং কিছুটা সূর্যের আকর্ষণের কারণে পৃথিবীর বুকে জোয়ার-ভাঁটা হয়, জোয়ারের সময় সেইসব জায়গার জলতল উঁচু হয়, অন্যত্র যেখানে ভাঁটা, সেখানে জলতল যায় নেমে। ফলে সব মিলিয়ে পৃথিবীর আকৃতি যে কীসের সঙ্গে তুলনীয়, তার উদাহরণ দেওয়া বেশ কঠিন। পৃথিবী ‘পৃথিবী’-রই মতো, এমনটা বললেই যেন ঠিক হয়।

বোঝবার সুবিধার জন্য আমরা পৃথিবীর আকার কেমন, একটা ছবিতে এখানে দেখাচ্ছি—

ছবি। পৃথিবীর আকার পুরোপুরি গোল নয়, এই আকারের বিশেষ নামঅভিগত গোলকাকার

পৃথিবীর আহ্নিক গতি

পৃথিবীর দু-ধরণের গতি, এটা আমাদের সকলেরই জানা। নিজের অক্ষের ওপরে যে ঘূর্ণন, সেখানে সে প্রতি চব্বিশ ঘণ্টায় একটা গোটা পাক খায়, এটার নাম আহ্নিক গতি বা Diurnal motion। যদিও সময়টা আসলে পুরোপুরি চব্বিশ ঘণ্টা নয়, তেইশ ঘণ্টা ছাপ্পান্ন মিনিট। একটু আগেই আমরা যেমন বলছিলাম, পৃথিবীর এই ঘূর্ণন অক্ষ, এটা সূর্যের চারপাশে পৃথিবীর যে ঘূর্ণন তল, সেই তলের সঙ্গে প্রায় সাড়ে তেইশ ডিগ্রি কোণ করে থাকে।

যেহেতু পৃথিবীর নিরক্ষরেখা বরাবর পরিধি উত্তর-দক্ষিণ বরাবর পরিধির চেয়ে কিছুটা বেশি, তাই নিরক্ষরেখা বরাবর পৃথিবীর গতি সবচেয়ে বেশি, ঘণ্টায় প্রায় সতেরোশো কিলোমিটার। এই গতির মান যত মেরুর দিকে এগোনো যায় ততই কমতে থাকে, একেবারে মেরু অঞ্চলে গতির মান প্রায় শূন্যই বলা চলে। এই আহ্নিক গতির কারণেই পৃথিবীতে দিন-রাত হয়, সমুদ্র বা নদীতে জোয়ার-ভাঁটা খেলে, বিভিন্ন রকমের বায়ুপ্রবাহ আর সমুদ্রস্রোত প্রবাহিত হয়। মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণিকুল সৃষ্টিই হতে পেরেছে এই আহ্নিক গতির জন্যই। একটা দিক সারা বছর যদি অন্ধকারেই ঢাকা থাকত, কোনোদিনই প্রাণের উদ্ভব হত না।

(ক্রমশ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

20 + 15 =