বিশ্ব উষ্ণায়ন কি হিমযুগের আগমনী?

বিশ্ব উষ্ণায়ন কি হিমযুগের আগমনী?

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৬ ডিসেম্বর, ২০২৫

বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি ভবিষ্যতের তপ্ততর পৃথিবীর দ্যোতক। কিন্তু সায়েন্স সাময়িকীতে প্রকাশিত ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, রিভারসাইড–এর বিজ্ঞানীদের সাম্প্রতিক এক গবেষণা এই ধারণাকে উল্টে দিয়ে এক অদ্ভুত সত্য সামনে আনছে। বলা হয়েছে অতিরিক্ত উষ্ণতা শেষ পর্যন্ত পৃথিবীকে উষ্ণতার বিপরীত প্রান্তে ঠেলে দিতে পারে, এমনকি একটি নতুন বরফযুগের সূচনাও ঘটাতে পারে।

দীর্ঘদিন ধরে বিজ্ঞানীরা মনে করতেন, পৃথিবীর জলবায়ু একটি ধীর কিন্তু নির্ভরযোগ্য প্রাকৃতিক তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এই ব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তি হলো শিলা ক্ষয়ের/আবহবিকারের মাধ্যমে কার্বন ডাই-অক্সাইড অপসারণ। বৃষ্টির জল বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে ভূমিতে পড়ে। সেই জল শিলার সঙ্গে বিক্রিয়া করে কার্বন ডাই-অক্সাইড আটকে ফেলে এবং তা নদী হয়ে সমুদ্রে পৌঁছায়। সেখানে এই কার্বন চুনাপাথর ও সামুদ্রিক খোলসে পরিণত হয়ে কোটি কোটি বছরের জন্য তলদেশে জমা থাকে। ফলে বায়ুমণ্ডল থেকে ধীরে ধীরে কার্বন ডাই-অক্সাইড কমে গিয়ে পৃথিবী ঠান্ডা হয়।

কিন্তু পৃথিবীর ভূতাত্ত্বিক স্মৃতি এই সরল ছবিকে মানতে চায় না। প্রাচীন ইতিহাসে এমন হিমযুগের চিহ্ন রয়েছে, যখন বরফ ও তুষার প্রায় পুরো গ্রহটাকে ঢেকে ফেলেছিল। এই চরম শীতলতাকে শুধু ধীর ভারসাম্য রক্ষাকারী ব্যবস্থার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যায় না। এই ধাঁধার উত্তর খুঁজতেই গবেষকরা আবিষ্কার করেছেন জলবায়ু ব্যবস্থার একটি অদৃশ্য প্রতিক্রিয়া চক্র।

এই নতুন ধারণার কেন্দ্রে রয়েছে সমুদ্রের জীবজগৎ তথা পুষ্টি উপাদান ও প্ল্যাঙ্কটন। পৃথিবী উষ্ণ হলে বৃষ্টিপাত বাড়ে এবং ভূমি থেকে বেশি পরিমাণে ফসফরাস প্রভৃতি পুষ্টি উপাদান নদী বেয়ে সমুদ্রে প্রবাহিত হয়। এই পুষ্টি প্ল্যাঙ্কটনের ব্যাপক বৃদ্ধি ঘটায়। প্ল্যাঙ্কটন সালোকসংশ্লেষের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে এবং মৃত্যুর পর তা সমুদ্রের তলদেশে ডুবে যায়। কার্বন কার্যত চিরদিনের জন্য আটকে পড়ে।

উষ্ণ পরিবেশে এই প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারে। কিন্তু সমস্যা শুরু হয় যখন অতিরিক্ত প্ল্যাঙ্কটন সমুদ্রের অক্সিজেন কমিয়ে দেয়। কম অক্সিজেনযুক্ত পরিবেশে ফসফরাস আবার জলে ফিরে আসে, যা আরও প্ল্যাঙ্কটন বৃদ্ধিকে উসকে দেয়। এই স্বয়ং বর্ধনশীল চক্র চলতে থাকলে সমুদ্র বিপুল পরিমাণ কার্বন গ্রাস করে এবং পৃথিবীর তাপমাত্রা দ্রুত কমতে শুরু করে—এমনকি আগের অবস্থার থেকেও অনেক নীচে নেমে যেতে পারে।

গবেষকদের মতে, প্রাচীন পৃথিবীতে বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেনের মাত্রা কম থাকায় এই প্রতিক্রিয়া ছিল অনেক বেশি শক্তিশালী, তাই হিমযুগগুলো ছিল ভয়াবহ রকমের চরম। আজকের পৃথিবীতে অক্সিজেন বেশি থাকায় এই প্রভাব তুলনামূলক দুর্বল হবে। তবু মনুষ্যসৃষ্ট বিশ্ব উষ্ণতার পর দীর্ঘ সময়ে একটি শীতল প্রতিক্রিয়া আসতে পারে, যা পরবর্তী হিমযুগের সময় এগিয়ে আনতে পারে।

তবে বিজ্ঞানীদের সতর্কবার্তা স্পষ্ট—এই দীর্ঘমেয়াদি শীতলতা আজকের জলবায়ু সংকটের কোনো মুক্তির পথ নয়। এই পরিবর্তন ঘটতে হাজার হাজার বছর লাগবে। মানবসভ্যতার জন্য সেটা কোনো স্বস্তির খবর নয়। তাই পৃথিবীর জলবায়ু একদিন নিজেই ভারসাম্য খুঁজে নিলেও, বর্তমান সময়ে আমাদের প্রধান দায়িত্ব একটাই—অপ্রতিরোধ্য বিশ্ব উষ্ণায়নকে এখনই নিয়ন্ত্রণ করা।

 

সূত্র: Global warming could trigger the next ice age by University of California – Riverside, 21st December 2025.

DOI: 10.1126/science.adh7730

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

seventeen + 5 =