বৈজ্ঞানিক পুস্তক -পরিক্রমা

বৈজ্ঞানিক পুস্তক -পরিক্রমা

সুপর্ণা চট্টোপাধ্যায়
বিজ্ঞানভাষ সম্পাদকীয় বিভাগ
Posted on ২৭ জুন, ২০২৫

২০২৫ সালে প্রকাশিত পাঁচটি প্রভাবশালী বিজ্ঞানের বই মানব সভ্যতার গভীরে লুকানো পাঁচটি প্রশ্ন তুলেছে –
১. সমাজ পরিকাঠামো কি শুধু প্রযুক্তির খেলা?
২. আইনস্টাইনের উত্তরাধিকার ঠিক কতখানি আজকের বিজ্ঞানে? ৩. কল্পবিজ্ঞান কি আমাদের বাস্তবতার সীমা বাড়িয়ে দেয়?
৪. মৃত্যু কি শুধু শারীরিক? আর
৫. ভেঞ্চার পুঁজির মোহজাল আমাদের উন্নয়নের চাকা টানে না কি ভেঙে দেয়?

এই বইগুলি যেন বিজ্ঞান, সমাজ ও কল্পনার সংযোগ। থাকলো এই পাঁচ নতুন বইয়ের ঝলক এবং সাথে একটি বিশ্লেষণ।

১. The Infrastructure Book – Sybil Derrible (Prometheus, 2025)
শহরের শিরা-উপশিরায় মানুষের গল্প

১৯৯৫ সাল। ভয়াবহ গ্রীষ্মের দাবদাহে, প্রাণ হারান ৭৩৯ জন। প্রশাসনের ধারণা হয়, শীততাপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের অভাবই এই গণমৃত্যুর মূল কারণ। কিন্তু পরে গবেষণায় উঠে আসে -আসল অপরাধী- সামাজিক বিচ্ছিন্নতা। শহর-পরিকাঠামো নিয়ে প্রকৌশলবিদ সিবিল ডেরিবলের গভীর বক্তব্য, “প্রযুক্তি বদলায়, প্রযুক্তি আসে-যায়; কিন্তু সমাজ পরিকাঠামো টিকে থাকতে পারে যদি মানুষ মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে।” ডেরিবল ১৬টি বড় শহরের জল, বিদ্যুৎ, পরিবহন ও টেলিকম ব্যবস্থার তথ্য বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর মতে, একটি শহরের স্বাস্থ্য বোঝা যায় তার অদৃশ্য সংযোগ জালের গুণমান দিয়ে এবং এগুলি প্রযুক্তির চেয়েও অনেক বেশি মানবিক সম্পর্কের ওপর নির্ভরশীল।

২. Free Creations of the Human Mind – Diana Kormos Buchwald & Michael D. Gordin (Oxford Univ. Press, 2025)আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের অনেক গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের উৎস কোথায়? ইতিহাসবিদ বুচওয়াল্ড ও গর্ডিন বলছেন, ২০০০ সালের পর পদার্থবিজ্ঞানে যত নোবেল দেওয়া হয়েছে, তার অন্তত সাতটি এসেছে আইনস্টাইনের ১৯০৫ ও ১৯১৫ সালের কাজের উপর নির্ভর করেই। এই ছোট বইটি আপেক্ষিকতা ও কোয়ান্টাম তত্ত্ব ছাড়াও আলোকপাত করেছে আইনস্টাইনের ব্যক্তিগত দর্শন, যুদ্ধ ও শান্তির প্রতি তাঁর দ্বৈত মনোভাব এবং পরমাণু বোমা নিয়ে তাঁর নৈতিক টানাপোড়েনের উপর।৩. Amazing Worlds of Science Fiction and Science Fact – Keith Cooper (Reaktion, 2025)১৯৯২ সালে প্রথম এক্সোপ্ল্যানেট আবিষ্কার। এখন সেই সংখ্যা প্রায় ৫,৯০০। তবুও জীবনের কোনও চিহ্ন নেই। বিজ্ঞান সাংবাদিক কিথ কুপার বলছেন, “এটি প্রমাণ করে পৃথিবীর বাইরে প্রাণ কতটা দুর্লভ! আর কল্পবিজ্ঞানের কল্পনা যত দূর যায়, বাস্তব বিজ্ঞান ততটাই কঠিন।” এই বইটি দেখিয়েছে, কল্পবিজ্ঞান কীভাবে বৈজ্ঞানিক চিন্তাকে প্রভাবিত করে, কোথায় এই দুই- এর মিলন হয় আবার কোথায় কেবলই তা কল্পনা হয়েই রয়ে গেছে!

৪. Yearning for Immortality – Rune Nyord (Univ. of Chicago Press, 2025)
অমরত্বের আকাঙ্ক্ষা: প্রাচীন মিশর, আধুনিক ভুল ব্যাখ্যা ও হায়ারোগ্লিফিকের আসল গল্প

মিশরের মমি ও মৃত্যুপরবর্তী জীবন সম্পর্কে ইউরোপীয় ব্যাখ্যাগুলো খ্রিস্টীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে গড়ে উঠেছে- এমনটাই বলছেন মিশরবিজ্ঞানী রুনে নিয়র্ড। তিনি প্রাচীন হায়ারোগ্লিফিক উৎস থেকে তুলে ধরেছেন, “মিশরীয় অমরত্বচিন্তা ছিল বহুমাত্রিক এবং ধর্মীয় কাঠামোর বাইরে একটি আলাদা দার্শনিক বাস্তবতা”।
এই বইটি ইতিহাস ও সংস্কৃতির মধ্যে বিজ্ঞানভিত্তিক পাঠ হিসাবে এক সেতুবন্ধকের মতন কাজ করে।

৫. World Eaters – Catherine Bracy (Dutton, 2025)
বিশ্বভোজীরা: প্রযুক্তি, ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ও বৈষম্যের গোপন খেলা
২০১৬ সালে ক্যাথারিন ব্রেসি Tech Equity প্রতিষ্ঠা করেন। উদ্দেশ্য ছিল প্রযুক্তিকে ‘সমতা আনার হাতিয়ার’ বানানো। কিন্তু বইটিতে তিনি সতর্ক করেছেন, “ভেঞ্চার ক্যাপিটাল এখন শুধুই মুনাফার খোঁজে বেড়ে চলেছে- মানবিকতার দিকে তাকিয়ে নয়” ফেসবুকের পুরনো নীতিই (Move fast and break things) এখন গোটা টেক-দুনিয়ার নীতিতে পরিণত হয়েছে। ব্রেসির বই বলছে, আমাদের এখন প্রযুক্তিকে গণতান্ত্রিক ও ন্যায়ভিত্তিক পথে ফেরত আনা অত্যন্ত প্রয়োজন।এই পাঁচটি বই পাঁচটি ভিন্ন পথের দিশা দেখায়। শহরের ভৌত কাঠামো থেকে মহাকাশ, আইনস্টাইন থেকে টেক স্টার্টআপ। তবে প্রশ্ন একটাই- বিজ্ঞান শুধু পরীক্ষা-নিরীক্ষা নয়, আমাদের সমাজ, মূল্যবোধ ও ভবিষ্যতের দিকনির্দেশক হতে পারছে কি? একটি প্রযুক্তির চেয়ে ঢের ভালো ‘মানব বিজ্ঞানের আহ্বান’। এই সব বইয়ের লেখায় তাই -ই প্রতিফলিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

12 + eight =