ব্যথামুক্তির কৃমি কৌশল

ব্যথামুক্তির কৃমি কৌশল

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৭ আগষ্ট, ২০২৫

মানুষের শরীরে কৃমি সংক্রমণ নতুন কিছু নয়। কিছু কিছু কৃমি এতটাই কৌশলী যে, তারা আমাদের শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিয়ে চুপি চুপি শরীরে প্রবেশ করে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা খুঁজে পেয়েছেন এমন এক পরজীবী কৃমি, যারা মানুষের ত্বকে ঢুকে যায় প্রায় বিনা বাধায়, কোনও ব্যথা বা চুলকানির অস্বস্তিকর অনুভূতি ছাড়াই। এই আবিষ্কার শুধু রোগ প্রতিরোধ নয়, ভবিষ্যতে ব্যথানাশক ওষুধ তৈরিতেও আশার আলো দেখাতে পারে।
স্কিস্টোসোমিয়াসিস নামের রোগের জন্য দায়ী এই কৃমি হল স্কিস্টোসোমা মানসোনি নামক হেলমিন্থ । হেলমিন্থ হচ্ছে কোমলদেহী, লম্বাটে, মেরুদণ্ডহীন কৃমি, যাদের অনেক প্রজাতি মানুষের বা প্রাণীর শরীরে পরজীবী হিসেবে বাস করে। এস. মানসোনির সংক্রমণ সাধারণত ঘটে দূষিত জলের সংস্পর্শে, যেমন নদীতে সাঁতার, কাপড় কাচা বা মাছ ধরা। জলের ভেতরের লার্ভা ত্বকের মধ্য দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে। আশ্চর্যের বিষয়, বেশির ভাগ রোগজীবাণু বা পরজীবী ত্বকে ঢোকার সময় ব্যথা, চুলকানি বা লালচে ভাব সৃষ্টি করলেও, এই কৃমির ক্ষেত্রে কিছুই অনুভব হয় না।
টিউলেন স্কুল অব মেডিসিনের গবেষকরা খুঁজে পেয়েছেন, এর রহস্য লুকিয়ে আছে স্নায়ুতন্ত্রের একটি বিশেষ প্রোটিনে—TRPV1+ । এই প্রোটিনই আমাদের শরীরে তাপ, ব্যথা ও চুলকানির সংকেত মস্তিষ্কে পৌঁছে দেয়। একই সঙ্গে সংক্রমণ, অ্যালার্জি, ক্যান্সার, স্ব-প্রতিরোধী রোগ এবং এমনকি চুল বৃদ্ধির প্রক্রিয়াতেও এদের ভূমিকা আছে। পরীক্ষায় দেখা গেছে, এস. মানসোনি এমন কিছু অণু তৈরি করে যা TRPV1+–এর কার্যকলাপ কমিয়ে দেয়। ফলে স্নায়ু সংকেত মস্তিষ্কে পৌঁছায় না। শরীর বুঝতেই পারে না যে ত্বকে কোনো পরজীবীর অনুপ্রবেশ ঘটছে।
বিজ্ঞানীদের ধারণা, কোটি কোটি বছরের বিবর্তনে এই ক্ষমতা ওই কৃমিদের বেঁচে থাকার কৌশল হিসেবে গড়ে উঠেছে। এখন, যদি বিজ্ঞানীরা ক্রিমিদের দেহ থেকে এই TRPV1+ নিষ্ক্রিয়কারী অণুগুলোকে আলাদা ও শনাক্ত করতে পারেন, তাহলে তা ভবিষ্যতের ব্যথানাশক ওষুধ তৈরির কাজে ব্যবহৃত হতে পারে। সেটা হবে বর্তমানে প্রচলিত ওপিওয়েড (ব্যথানাশক) ভিত্তিক ওষুধের এক নিরাপদ বিকল্প।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, TRPV1+ শুধু ব্যথা–চুলকানি নয়, সংক্রমণ প্রতিরোধেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি সক্রিয় হলে ত্বকে দ্রুত γδ -টি সেল, মনোসাইট ও নিউট্রোফিল প্রতিরোধী কোষ সমবেত হয় এবং প্রদাহ সৃষ্টি করে, যা লার্ভাকে প্রবেশে বাধা দেয়।

ড. ডি’ব্রোস্কি আর. হারবার্টের মতে, যদি এস. মানসোনির TRPV1+ নিষ্ক্রিয়কারী অণু শনাক্ত করা যায়, তাহলে স্কিস্টোসোমিয়াসিস প্রতিরোধে নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি তৈরি করা সম্ভব । ভবিষ্যতে হয়তো এমন মলম তৈরি হবে, যা TRPV1+কে সক্রিয় করে কৃমির লার্ভাকে ত্বকের মধ্যে প্রবেশে বাধা দেবে, বিশেষ করে দূষিত জলের সংস্পর্শে আসা মানুষের ত্বকে।

গবেষক দল এখন কৃমির ক্ষরণজাত বা পৃষ্ঠ–সংযুক্ত সেই অণুগুলোর প্রকৃতি শনাক্ত করার চেষ্টা করছে। কোন ধরণের γδ টি- সেল এই প্রতিরোধে সবচেয়ে বেশি কাজ করে, তা খুঁজে দেখছেন। এই জ্ঞান একদিকে ব্যথানাশক উদ্ভাবনে, অন্যদিকে সংক্রমণ প্রতিরোধে মস্ত ভূমিকা পালন করতে পারে।

সূত্র: “TRPV1+ neurons promote cutaneous immunity against Schistosoma mansoni” by Juan M Inclan-Rico, Adriana Stephenson, et.al; (7.8.2025), The Journal of Immunology.
DOI: 10.1093/jimmun/vkaf141

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

4 × 1 =