ভলফগ্যাং পাউলির বর্জন-নীতির শতবর্ষ

ভলফগ্যাং পাউলির বর্জন-নীতির শতবর্ষ

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১৬ মার্চ, ২০২৫

১৮৯৬ সালে জে জে টমসন ইলেকট্রন আবিষ্কার করে প্রমাণ করে দিলেন পরমাণু মোটেই অ-কাট্য নয়, তার চেয়েও ছোটো কণার অস্তিত্ব আছে। ১৯১১ সালে আর্নেস্ট রাদারফোর্ড দেখালেন পরমাণুর একটা কেন্দ্রক থাকে আর তাকে ঘিরে পাক খায় ইলেকট্রনেরা। এর পর নীল্‌স বোর উঠেপড়ে লাগলেন কী করে ইলেকট্রনেরা পরমাণুর মধ্যে নিজ নিজ কক্ষপথে ঘুরপাক খায় তা ব্যাখ্যা করার জন্য। তিনি কাজে লাগালেন ম্যাক্স প্লাঙ্কের কোয়ান্টম তত্ত্বকে। তার মূল কথা হল শক্তি নির্গত হয় এক একটা পুঁটুলিতে, যার নাম কোয়ান্টাম। হাইড্রোজেন পরমাণু হল সবচেয়ে সরল। তাতে থাকে একটি প্রোটন আর একটি ইলেকট্রন। তার বর্ণলিপি নিয়ে চলল গবেষণা। বোর খানিকটা সৌর জগতের ধাঁচে একটা মডেল বানালেন। সূর্যকে ঘিরে যেমন পাক খায় গ্রহরা, তেমনি পরমাণুর কেন্দ্রককে ঘিরে বিভিন্ন কক্ষে পাক খায় ইলেকট্রনেরা। একেকটা কক্ষের একেক রকম শক্তিমাত্রায় ইলেকট্রন বিকিরিত হয় না, তাই পরমাণু থাকে সুস্থিত। আলো কয়েকটা নির্দিষ্ট কপাঙ্কেই নির্গত বা শোষিত হয়। দুটি কক্ষের শক্তিমাত্রার পার্থক্যর ওপর সেই কম্পাঙ্কগুলো নির্ভরশীল। একটা “মুখ্য কোয়ান্টাম সংখ্যা”র নিরিখে কক্ষগুলির শক্তিমাত্রার বিভিন্ন মান ধার্য করলেন বোর। এর ফলে হাইড্রোজেন পরমাণুর বর্ণ-লিপির সবটা না হলে কিছুটা ব্যাখ্যা দেওয়া গেল। বোরের যাত্রা কিন্তু থামল না। একদিকে আইনস্টাইনের সীমিত আপেক্ষিকতার তত্ত্ব, অন্যদিকে কোয়ান্টাম তত্ত্ব-ভিত্তিক নানারকম অনুমান নিয়ে ভাবনাচিন্তা চলল। এইসব কোয়ান্টাম তত্ত্ব-ভিত্তিক ভাবনাগুলি কিন্তু সাবেকি নিউটনীয় পদার্থবিদ্যার সঙ্গে একেবারে বেমানান। বোর এবার আরও দুটো কোয়ান্টাম সংখ্যার অবতারণা করলেন। তার মধ্যে একটা সংখ্যা ইলেকট্রনের কৌণিক ভরবেগের মানের সূচক, অন্যটা তার চৌম্বক ভ্রামকের (মোমেন্ট) সূচক। এবার যেন ধাঁধার উত্তর কিছুটা মিলল। কিন্তু তাও হাইড্রোজেন বর্ণলিপির মূল ধাঁধাটা রয়েই গেল। ১৯২৩-২৪ নাগাদ জিম্যান দেখালেন, কক্ষপথে পাক-খাওয়া ইলেকট্রনগুলো যখন বাইরের কোনো চৌম্বক ক্ষেত্রর সঙ্গে ক্রিয়া করে, তখন নতুন বাড়তি বর্ণলিপি ফুটে ওঠে। কেন এমন হয়?
এইখানেই মঞ্চে প্রবেশ ভলফগ্যাং পাউলি (১৯০০-১৯৫৮)-র, তাঁর বয়স তখন ২৪। তখনই গণিতে ধুরন্ধর বলে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। তিনি একটা নতুন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ধাঁধাটা সমাধান করতে চাইলেন। বোর-এর দেওয়া তিনটে সংখ্যার সঙ্গে একটা নতুন চতুর্থ কোয়ান্টাম সংখ্যা যোগ করলেন তিনি, কিন্তু তার সঙ্গে বোরের সংখ্যাগুলোর চরিত্রের মিল নেই। বোরের সংখ্যাগুলো ছিল সাবেকি নিউটনীয় পদার্থবিজ্ঞান-সম্মত; আর পাউলির সংখ্যাটা নতুন কোয়ান্টাম তত্ত্ব-সম্মত। সেই সংখ্যাটা স্পিন-এর সূচক। তার দুটো মান হতে পারে। একটা পজিটভ (+), একটা নেগেটিভ(-)। এই তত্ত্ব অনুযায়ী বাইরের চৌম্বক ক্ষেত্রর সঙ্গে ক্রিয়া ঘটানোর সময় দুই বিপরীত মানযুক্ত ইলেকট্রন আলাদা আলাদা ভাবে ক্রিয়া করবে। আর তারই ফলে বর্ণলিপি দুভাগ হয়ে দেখা দেবে ওই বাড়তি নতুন বর্ণলিপি, যার কথা বলেছিলেন জিম্যান। পাউলি দেখালেন, পরমাণুর মধ্যে কোনো দুটো ইলেকট্রনের পক্ষে চারটি কোয়ান্টাম সংখ্যার একটা সেটকে ভাগাভাগি করে নেওয়া কখনো সম্ভব নয়। অর্থাৎ একটা ইলেকট্রনকে বর্জন করতেই হবে। এই ধারণাই ‘পাউলি বর্জন তত্ত্ব’ নামে প্রসিদ্ধ। তখনো নতুন কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞানের সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু পাউলির এই তত্ত্বর মধ্যে কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞানের আভাস মিলল। ১৯৪৫ সালে পাউলি তাঁর এই আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরস্কার পান।
বিশ শতকের শেষের দিকে পদার্থবিজ্ঞানীরা বুঝলেন, পদার্থের সুস্থিতির মূলে এই পাউলি বর্জন নীতি-র এক মস্ত ভূমিকা আছে। এই বর্জন নীতির সঙ্গে কোয়ান্টাম পরিসংখ্যান আর পদার্থের সুস্থিতির একটা সুনির্দিষ্ট গাণিতিক সম্পর্ক অনুসন্ধানে কেটেছে দশকের পর দশক। ১৯৬৭ সালে ফ্রিম্যান ডাইসন প্রমাণ করলেন, পদার্থের সুস্থিতির জন্য পাউলির বর্জন নীতি শুধু যথেষ্টই নয়, আবশ্যিকও বটে। চারটি কোয়ান্টাম সংখ্যা আর পাউলির বর্জন নীতির সাহায্যে মেন্ডেলিয়েভের পর্যায়সারণির আরও উন্নত রূপ গড়ে তোলা সম্ভব হল। শুধু তাই নয়, পদার্থের নতুন নতুন অজানা রূপেরও একটা নির্দেশিকা গড়ে তোলা সম্ভব হল। বিশ শতকের শেষে সত্যেন্দ্রনাথের নামাঙ্কিত বোস-আইনস্টাইন অতিঘনবস্তু (কন্ডেন্সেট) নামে এক নতুন ধর্মযুক্ত পদার্থরূপ আবিষ্কৃত হল। এইভাবে যুগ যুগ ধরে পাউলির তত্ত্ব আমাদের পথ দেখিয়ে চলেছে – জ্যোতিঃ-পদার্থবিজ্ঞান থেকে শুরু করে অতিঘনবস্তু পদার্থবিজ্ঞানে। এক সময় মনে হত পাউলি ত্তত্ব বুঝি সংখ্যার জাদু; আজ সেটা বিজ্ঞানের এক কেন্দ্রীয় স্তম্ভ।
সূত্রঃ : Nature 639, 296-299 (2025)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

four × 3 =